কয়েক বছর ধরে মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন রাজধানীর গৃহবধূ আফরোজা। চিকিৎসা নিতে রাজধানীর সরকারি একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসক। ব্যবস্থাপত্রে পাঁচটি ওষুধের নাম লেখা হলেও একটিতেও ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা হয়নি। ব্যবস্থাপত্রে রোগের নামও উল্লেখ করেননি চিকিৎসক।
শুধু এই রোগী নন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের বড় অংশের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটছে।
৯০ শতাংশ চিকিৎসকই ব্যবস্থাপত্রে পছন্দের কোম্পানির ওষুধের বাণিজ্যিক নাম লিখে দিচ্ছেন। আর রোগীদের বাড়তি অর্থ দিয়ে কিনতে হচ্ছে সেই ওষুধ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফিজিশিয়ান প্র্যাকটিস ম্যানুয়ালের তথ্য বলছে, রোগীর জন্য সহজলভ্য ও দাম তুলনামূলক কম, এমন ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে হবে ব্যবস্থাপত্রে।
২০১৭ সালে হাইকোর্ট এ-সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে। তাতে বলা হয়, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে হবে। একই সঙ্গে স্পষ্ট অক্ষরে ‘পড়ার উপযোগী করে’ ব্যবস্থাপত্র লিখতে হবে।
নির্দেশনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৩০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল। বাস্তবতা হলো পাঁচ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এসব নির্দেশনার কোনোটিই মানছেন না দেশের চিকিৎসকরা।
এই নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে আগে দেখতে হবে অন্য দেশে ওষুধ বিক্রেতা কারা, আর আমাদের দেশে কারা ওষুধ বিক্রি করে। এখানে ওষুধের দোকানগুলোর কত শতাংশে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট আছেন?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ব্যবস্থাপত্র লেখার সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। এটি অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এমন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিলেই চলবে না। ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশনা বাস্তবায়নের আগে ওষুধের দোকানগুলোতে ফার্মাসিস্ট থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ওষুধের সমান মান নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে জটিলতা বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ফয়েজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে আগে দেখতে হবে অন্য দেশে ওষুধ বিক্রেতা কারা, আর আমাদের দেশে কারা ওষুধ বিক্রি করে। এখানে ওষুধের দোকানগুলোর কত শতাংশে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট আছেন? বাইরের দেশে শতভাগ এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কারণ সেখানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট ওষুধ বিক্রি করেন। আমাদের দেশে এটা নেই।’
‘ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক লেখাটা ভালো। তবে এই নির্দেশনা রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই ফার্মাসিস্ট না থাকা ওষুধের দোকানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এক রোগ সারানোর জন্য একাধিক কোম্পানির ওষুধ বাজারে রয়েছে। সব ওষুধের গুণগত মানও এক নয়। এই ব্যবস্থাপত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া একজন বিক্রেতার কাছে গেলে তো সমস্যা। তিনি মানসম্পন্ন ওষুধ দিতে পারবেন কি না, সেই সংশয় থেকে যায়। ওষুধের দোকানে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট বসলে তখন এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব।’
দেশে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি। তাই জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আগে সব কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের মান শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
ইতোমধ্যে কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতালে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার বিধান চালু হয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ টি এম জাফরুল আজিম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জেনেরিক নামে লিখলে ফার্মেসিগুলো ভালো মানের ওষুধ দিতে পারে রোগীকে। আর ব্যবস্থাপত্রে একটি কোম্পানির ওষুধ লিখলে ফার্মেসিগুলো সেই কোম্পানির ওষুধ দিতে বাধ্য থাকবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ফার্মেসিগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিম্নমানের ওষুধ দেন রোগীকে।’
দীর্ঘদিনেও এ-সংক্রান্ত আইন না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. জাফরুল আজিম বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সরকারের পলিসিগত দুর্বলতা আছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থগত বিষয়ও আছে। সরকার চাইলে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। যেমন কিছু হাসপাতাল এই প্র্যাকটিসটা করছে। স্কয়ার, এভারকেয়ারসহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার হচ্ছে।’
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই মাহবুব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি। তাই জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আগে সব কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের মান শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’