সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। মর্যাদা পাবে উন্নয়নশীল দেশের। এরপর দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধশিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও বিচলিত নন দেশীয় ওষুধশিল্পের মালিকরা।
নিউজবাংলাকে তারা জানান, ২০২৬ সালের পর তারা কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন না। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ওষুধশিল্প পার্ক উৎপাদনে যাবে। তারা আশা করছেন, এতে ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বৈশ্বিক বাস্তবতায় দেশের অন্য খাতগুলোয় এর প্রভাব পড়লেও পড়তে পারে। তবে ওষুধশিল্পে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং উত্তরণজনিত নানা সম্ভাবনা তৈরি হবে।’
- আরও পড়ুন: ‘২০২৬ সালের আগেই দাঁড়িয়ে যাবে ওষুধশিল্প’
তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রাজত্ব করার মতো সম্ভাবনা তৈরি হতে যাচ্ছে। আমরা কোভিড রোগীর চিকিৎসার ওষুধ তৈরি করতে পেরেছি। যদিও এটা অনেকের কাছে বিস্ময়ের ছিল। কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষম হলে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারব। এপিআই পার্ক পূর্ণাঙ্গ চালু হলে আমাদের সেই সুযোগ তৈরি হবে।’
আগামী এক বছরের মধ্যে ওষুধশিল্প পার্ক উৎপাদনে যাবে। ওষুধশিল্পের মালিকরা আশা করছেন, এতে ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাবে। ফাইল ছবি
বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কপিরাইট আইন বা মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। এ সুবিধার আওতায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো রয়্যালটি বা ফি দিতে হয় না। যে কারণে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সস্তায় ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন এ সুবিধা আর থাকবে না। এতে করে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
তবে ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, ‘২০৩২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধার মেয়াদ আছে। এটাই আমাদের বড় শক্তি। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে ওষুধশিল্প পুরোপুরি নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে।’
ওষুধশিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও হেলথকেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হালিমুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওষুধের ক্ষেত্রে বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। ১৫৮টি দেশে আমরা ওষুধ রপ্তানি করছি। যেসব ওষুধ আমরা উৎপাদন ও রপ্তানি করছি, বর্তমানে তার সিংহভাগের মৌলিক কাঁচামাল আমদানি করছি।
‘২০২৬ সালের মধ্যে ওষুধ খাতে আমাদের ব্যাপক বিনিয়োগ হবে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বাড়বে। তখন কাঁচামালের আমদানি খরচ কমে আসবে। ওষুধ উৎপাদন খরচও কমবে। অন্যদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের ওষুধের খ্যাতি, গ্রহণযোগ্যতা এবং চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে রপ্তানিও বাড়বে। এটাই সম্ভাবনার বড় জায়গা।’
একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান সিনহা জানান, দেশে ওষুধশিল্পের ভিত এতটাই মজবুত অবস্থানে পৌঁছে গেছে এবং এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে বিরাট বাজার তৈরি হয়েছে, সেখানে উত্তরণজনিত চ্যালেঞ্জ খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’
তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে, তখন জেনেরিক ওষুধ তৈরিতে বিদেশি পেটেন্টের ব্যবহারের জন্য রয়্যালটি দিতে হবে। এতে ওষুধের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে এবং তার প্রভাবে দামও বেড়ে যাবে। সেটি একটি শঙ্কা যদি আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ না করি।
‘কিন্তু দেশের ওষুধশিল্প অনন্য উচ্চতায় চলে গেছে। তাই সে ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি যাতে আমাদের না হতে হয়, সে জন্যই তো আমরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আগে থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। সে লক্ষ্যেই দেশে এপিআই পার্ক তৈরি করা হচ্ছে।’
- আরও পড়ুন: উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায় ওষুধ শিল্প পার্ক
তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধ তৈরি করতে যে একটা বেসিক র’ ম্যাটেরিয়ালস লাগে, এপিআই পার্কে আমরা সেটাই তৈরি করব। আবার যেটা দেশে উৎপাদন হয় না, তার র’ বেসিকটা আমদানি করে আমরা ফিনিশড ওষুধে রূপান্তর করব।’
এপিআই পার্কে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা যদি তা করতে সমর্থ হই, তাহলে উত্তরণের পরও আমাদের ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে রপ্তানির পরিমাণও বহুগুণ বাড়বে, যা ওষুধশিল্পকে বিশ্ব দরবারে আরও নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাবে।
ওয়ান ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ‘ওষুধ উৎপাদনের জন্য দরকার প্রযুক্তি তথা যন্ত্রপাতি, বিনিয়োগ ও জনবল। বাংলাদেশে এর কোনোটির ঘাটতি নেই। আমাদের শক্তিশালী টেকনোলজি রয়েছে। আছে ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্টের দক্ষ জনশক্তি। এ দুইয়ের সমন্বয়ে আগামীতে এপিআই পার্ক পুরোপুরি চালু হলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারব।’