বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান দখল করে আছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন জামদানি শাড়ি। বছরের সব সময় এই শাড়ির চাহিদা থাকলেও বিভিন্ন উৎসবে চাপ থাকে বেশি।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর খুব বেশি দূরে নয়। ঈদ সামনে রেখে জামদানি শাড়ির চাহিদা মেটাতে এরই মধ্যে ব্যস্ততা বেড়েছে ফরিদপুরের জামদানি তাঁতিদের।
গত কয়েক বছর ধরে বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নে সোতাসী, মজুরদিয়া গ্রামের তাঁতিরা রেশমি সুতা থেকে জামদানি বুনছেন।
কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাঁত বসিয়ে মসলিন জামদানি তৈরি শুরু করেছেন। এখন থেকেই দিনরাত চলছে জামদানির তৈরির কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সূর্য ওঠার সঙ্গেই কাজে নামেন কারিগররা।
কীভাবে শুরু
জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নে প্রায় ১৫ বছর আগে সোতাশী ও পাশের মজুরদিয়া গ্রামের কয়েকজন কিশোর কাজের সন্ধানে নারায়ণগঞ্জ জেলার জামদানি পল্লিতে কাজ নেয়। সেখানে দুবছর কাজ করে।
প্রথমে অল্প বেতনে কাজ শুরু করে তারা। কাজ শেখার পর মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় হতো। এই টাকা দিয়ে কোনো রকমে চলত সংসার।
অভাবেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নিজেদের তাঁত স্থাপনের মাধ্যমে বেশি আয়ের। সেই অনুযায়ী কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লিতেই তাঁত বসানোর চেষ্টা করলে বাধা দেন অন্য তাঁতমালিকরা।
এতে অনেকের স্বপ্ন ভাঙে। এরপরও হাল ছাড়েননি জেলার বোয়ালমারীর আবু নাছের ও তৌহিদ বিশ্বাসরা। ফেরেন নিজ গ্রামে।
লালিত স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় মনোবল আর জেদকে কাজে লাগিয়ে একটি তাঁত স্থাপন করে মসলিন জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন তৌহিদ বিশ্বাস। নিজের ভাই ইউসুফ বিশ্বাসসহ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দেন তাঁত চালানোর। এরই মধ্যে পাঁচটি তাঁত স্থাপন করেন তিনি।
একইভাবে ওই গ্রামের আবু নাছের, স্ত্রী আল্লাদী বেগম ও তার ভাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আটটি তাঁত স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছেন। প্রতিটি তাঁত থেকে দুজন কারিগরের মাধ্যমে মাসে পাঁচটি মসলিন জামদানি শাড়ি তৈরি করা হয়।
রেশমি সুতায় তৈরি জামদানি শাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা
শাড়ির দাম
আবু নাছের জানান, প্রত্যেকটি শাড়ির দাম সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। কোনো শাড়িতে ৬০০ থেকে ৮০০, কোনোটিতে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকার সুতা প্রয়োজন হয়। শাড়ির ওজন হয় দুই থেকে আড়াইশ গ্রাম।
উপজেলার মজুরদিয়া এলাকার আলী আকবর বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর হলো বাড়িতে একটি টিনের ঘর তুলে ৬টি তাঁত বসিয়েছি। প্রতিটি তাঁত থেকে দিনে ৪ থেকে ৫টি শাড়ি তৈরি করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কারিগর আর মেশিনারি সমস্যাসহ নানা বিষয়ে সমস্যা রয়েছে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ‘
কী বলছেন উদ্যোক্তারা
নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতি ভরি সুতা ৬০ থেকে ৮৫ টাকায় কিনতে হয়। খরচ বাদে বিক্রি করা শাড়ির লাভের টাকার অর্ধেক কারিগরের। বাকি অর্ধেক থেকে হেলপারের বেতন দিয়ে যা থাকে তা মালিকের। কারিগরদের অনেকেই প্রাথমিক স্তরের হলেও লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা কাজ করে।
এমনই খুদে কারিগর জিহাদ বিশ্বাস, হৃদয়, জাহিদ, আরশাদ, সাগর বিশ্বাস ও দ্বীন ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
তারা নিউজবাংলাকে জানায়, কাজ করতে ভালোই লাগে। উপার্জিত অর্থ লেখাপড়াসহ সংসারের কাজে লাগানো যায়।
উদ্যোক্তা তৌহিদ বিশ্বাস বলেন, ‘উৎপাদিত শাড়ি বিদেশে চলে যায়। আমরা নারায়ণগঞ্জের ফড়িয়াদের কাছে তাদের নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করি। এ শাড়ির স্থানীয় বাজার সৃষ্টি করা গেলে অনেকেই এ পেশায় আসবে।’
তৌহিদ আরও বলেন, ‘এ ব্যবসা পরিচালনা করতে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ করতে হয়েছে। ফলে পেশাটি লাভজনক হলেও লাভের মুখ দেখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
স্থানীয় সাতৈর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, ফরিদপুরে তাঁতশিল্প কারিগরদের হাতে তৈরি বেনারসি জামদানির চাহিদা বেশ রয়েছে। তবে সময়মতো কারিগর ও অর্থের অভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অন্য পেশায় যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি জামদানি কারিগরদের কথা শুনেছি। তবে খোঁজ নেয়া হয়নি। আমি নিজে খোঁজ নিয়ে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’