রাজধানীতে ওয়েবিলের নামে নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্বিগুণ, কখনও তার চেয়ে বেশি হারে ভাড়া আদায় বন্ধ করতে না পারা, সব বাসে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করতে না পারায় সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কক্ষের সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ করলেন একদল ছাত্র।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের (নিসআ) ব্যানারে ২০ জনের মতো ছাত্র-ছাত্রী এই কর্মসূচি পালন করেন। তারা ওয়েবিলের নামে অবৈধ বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধসহ মোট নয়টি দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবি পূরণে সাত দিন সময় বেঁধে দিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, না হলে আবার তারা ভবনে যাবেন।
রোববার দুপুরে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ ভবনের ষষ্ঠতলায় চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে এই বিক্ষোভ শেষে চেয়ারম্যানের আশ্বাসে তারা স্থান ত্যাগ করেন।
শিক্ষার্থীরা কক্ষের সামনে স্লোগান দেন, পাশাপাশি ভবনের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় তাদের দাবিগুলো লিখে রাখেন।
বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র ইনজামুল হক রামীম বলেন, ‘আমরা বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে বলেছি, নয়টা দাবির মধ্যে কয়টা দাবি আপনারা বাস্তবায়ন করেছেন? আসলে তারা কোনো কাজই করেন না।
‘প্রতিনিয়ত তারা যে আশ্বাস দেন, আজও সে রকম আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা তাদের আশ্বাসে এখনও সন্তুষ্ট নই। দাবি বাস্তবায়নে তাদের এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। না মানলে এক সপ্তাহ পর আমরা আবার আসব।’
শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিসংবলিত বিভিন্ন ব্যানার ও পোস্টার বিআরটিএ কার্যালয়ে সাঁটিয়ে দিয়ে আসে২০২১ সালের শেষে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নেয়ার লিখিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও সব বাসে তা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকাশ পরিবহন নামে একটি বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে অস্বীকার করেছে বলে অভিযোগ তাদের।
আবার রাত ৮টার পর আর ছুটির দিন শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার সুবিধা থাকে না। কিন্তু তাদের বক্তব্য হচ্ছে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ও পড়াশোনা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা পেরিয়ে যায়। ছুটির দিনেও ক্লাস-পরীক্ষা হয়। লেখাপড়া সংক্রান্ত জরুরি কাজও থাকে। তাহলে কেন অর্ধেক ভাড়া কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ে থাকবে।
শিক্ষার্থীরা ওয়েবিলের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও প্রতিবাদ জানান। গত নভেম্বরের শুরুতে বাস ভাড়া বাড়িয়ে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণের পর বিআরটিএ ঘোষণা দিয়েছিল ওয়েবিলের নামে কোনো বাস চলবে না। বাসমালিকরাও অঙ্গীকার করেন, তারা ভাড়া আদায় করবেন কিলোমিটার হিসাব করেই।
তবে এই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। আর রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এখন এক নিয়মিত চিত্র। তবে বিআরটিএপ্রধান সম্প্রতি নিউজবাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ঢাকা শহরে কোন বাস ওয়েবিলে চলে, সেটি তার জানা নেই।
- আরও পড়ুন: এখনও ওয়েবিল, জানেই না বিআরটিএ
শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র বলেন, ‘সিটিং-ওয়েবিলের মাধ্যমে এখনও বিভিন্ন বাসে সব সময়ই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যেগুলোর যথোপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে।
‘উপরন্তু সড়কে আহত-নিহতরা এখনও সড়ক আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণসহ পূর্ণ ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।’
আগের কথাই বললেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে বিআরটিএপ্রধানের কাছে কার্যত কোনো জবাব ছিল না। বৈঠক শেষে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের যা বলেন, সেসব কথা এর আগেও বহুবার বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘ওয়েবিলের যে বিষয়টা বললেন, এটা আমরা আগেও বেআইনি বলেছি। পরবর্তীতে মালিক সমিতির সভা ডেকে তাদের মুখ দিয়েই এটা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তারা বলেছে তারা ওয়েবিলে ভাড়া নেবে না। আমরা এ বিষয়ে খুব কঠোর অবস্থানে আছি।
‘আমাদের মোবাইল কোর্ট সপ্তাহে ছয় দিন পরিচালিত হয়। যারা বেশি ভাড়া নেয় বা ওয়েবিলে ভাড়া নেয় তাদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর বাইরেও কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, আমরা সেটারও ব্যবস্থা নিই।’
বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যানবিআরটিএ ভবনের সামনে দিয়ে চলা বিকাশ পরিবহনেই ওয়েবিল পদ্ধতিতে ভাড়া নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেই তো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। তাহলে আপনারা আসলে কী করছেন- এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যান বিআরটিএ প্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমি বলতেছি যে বিকাশ কোনো বিষয় না। যে পরিবহনই আইন লঙ্ঘন করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনছি আমরা। আমাদের কাছে তো অভিযোগ দিতে হবে।’
অভিযোগ দিতে হবে কেন? যারা আপনাদের ম্যাজিস্ট্রেট তারা কি নিজেদের ভবনের সামনের পরিবহন খেয়াল করেন না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনি এককথা বারবার বলছেন। ওয়েবিলের বিরুদ্ধে অলরেডি রাস্তায় কাজ করছে। জরিমানার আওতায় আনতেছে। কেউ অভিযোগ দিলে সেটা আমরা তো নিচ্ছি।’
গত এক মাসে কতগুলো অভিযোগ নিয়েছেন, জানতে চাইলে নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘গত এক মাসের পরিসংখান চাইলে আমার অফিস থেকে নিতে হবে আপনাকে।’
৯ দফা দাবি
# দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শিক্ষার্থীসহ সকল সড়ক ‘হত্যার’ বিচার করতে হবে ও পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
# ঢাকাসহ সারা দেশে সকল গণপরিবহনে (সড়ক, নৌ, রেল ও মেট্রোরেল) শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
# গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য যথাস্থানে ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপত্তাব্যবস্থা দ্রুততর সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
# সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সকল যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
# পরিকল্পিত বাসস্টপেজ ও পার্কিং স্পেস নির্মাণ এবং সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। (এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে)।
# দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ও যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা মহলকে নিতে হবে।
# বৈধ ও অবৈধ যানবাহনচালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনতে হবে এবং বিআরটিএর সকল কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
# আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অবিলম্বে স্বয়ংক্রিয় ও আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।
# ট্রাফিক আইনের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে।