বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিসিবির ট্রাকের পেছনে কেন দৌড়াতে হচ্ছে মানুষকে

  •    
  • ৯ মার্চ, ২০২২ ২২:২২

রাজধানীতে মোট ৪৫০টি স্থানে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করা হয়। কিন্তু ট্রাক আছে ১৫০টি। ফলে একেক দিন দেড় শ স্থানেই বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে কখন বা কোনদিন ট্রাক যাবে, সেটি আগে থেকে জানতে পারেন না ক্রেতারা। আবার প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়েও আসে না ট্রাক। ফলে অপেক্ষায় থাকা মানুষ ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি করতে থাকেন। টিসিবির দাবি, তারা ওয়েবসাইটে আগের রাতে তালিকা দিয়ে দেয়। কিন্তু ট্রাক থেকে যারা পণ্য কেনেন, তাদের পক্ষে ওয়েবসাইট ঘেঁটে তথ্য জানা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কে আগে এসেছেন- এই নিয়ে দ্বন্দ্ব। শুরুতে ধাক্কাধাক্কি। এরপর মারামারি।

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ কতটা বিপাকে, সেটি ফুটিয়ে তুলছে স্বল্পমূল্যের পণ্য কিনতে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির ট্রাককে ঘিরে মানুষের আকুতি।

একেকটি ট্রাক আসছে, মানুষ দৌড়াচ্ছেন, কোথাও কোথাও ঝুলে থাকছেন, কোথাওবা কাতর হয়ে পণ্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন- এই চিত্র এখন এক স্বাভাবিক চিত্র। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন ছবি ভাইরাল হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এভাবে দৌড়াতে হচ্ছে? একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় এনে এই বিষয়গুলো কি ঠেকানো সম্ভব নয়?

টিসিবির একটি ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেল, এই বিষয়টি মাথাতেই নেয়নি সংস্থাটি।

রাজধানীতে মোট ৪৫০টি স্থানে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করা হয়। কিন্তু টিসিবির ট্রাক আছে ১৫০টি। ফলে একেক দিন দেড় শ স্থানেই পণ্য বিক্রি করা হয়।

এই ১৫০টি স্থানে কখন বা কোনদিন ট্রাক যাবে, সেটি আগে থেকে জানতে পারেন না ক্রেতারা। আবার প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়েও আসে না ট্রাক। ফলে অপেক্ষায় থাকা মানুষ হুড়োহুড়ি করতে থাকেন।

টিসিবির দাবি, তারা ওয়েবসাইটে আগের রাতে তালিকা দিয়ে দেয়। কিন্তু ট্রাক থেকে যারা পণ্য কেনেন, তাদের পক্ষে ওয়েবসাইট ঘেঁটে তথ্য জানা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

রাজধানীর একটি পয়েন্টে টিসিবির খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে ক্রেতার দীর্ঘ সারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

‘এইখানে আসব, ওইখানে আসব কইরা আর আসে নাই’

ঘটনাস্থল রাজধানীর ফার্মগেট, সুনির্দিষ্ট করে বললে তেজগাঁও কলেজের সামনে। তখন সকাল ১০টা ৭ মিনিট। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ হঠাৎ নিজেদের মধ্যে মারমারি শুরু করলেন।

ট্রাক সেলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতেই এ রকম ঘটনা ঘটিয়েছেন পুরুষরা। পাশে আরেকটি লাইনে শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে অনেক নারী ক্রেতা নিজেরাই তৈরি করেছেন মানবঢাল। এত উদ্যোগ যেন কিছুই কাজে আসছে না। থেমে থেমে বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে সেই লাইন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সোহাগ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি আইছি একবারে প্রথমে ৯টা বাজে। তখন গাড়ি ছিল না। মানুষ সবাই ওইদিকে দাঁড়াইয়া ছিল। গাড়িডা আইছে আর কয় আমরা আছিলাম। যে যেমনে পারছে মানুষ ঢুইকা গেছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন এক টাইমে আসে না। কালকে তো ১টা পর্যন্ত ছিলাম। এইখানে আসব, ওইখানে আসব কইরা আর আসে নাই। পাই নাই কোনো গাড়ি।’

জিগাতলা ট্যানারির মোড়ের শের-এ-বাংলা রোডের পান বিক্রেতা গোলাম হোসেন দীপু বলেন, ‘এখানে মাত্র এক দিন আসছে, আর আসে নাই। গতকালও আইসা অনেকেই জিগায় গাড়ি-গুড়ি আইছে নাকি। আমিও তো পাই নাই।… ৬ তারিখ আইছে আর আসে নাই।’

মঙ্গলবার সকাল ৭টায় এসে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো পণ্য নিতে পারেননি মনিপুরীপাড়ার বাসিন্দা তসলিম হোসেন। পরের দিন সকাল ৭টায় এসে খামারবাড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে শুনলেন যে গাড়ি তেজগাঁও কলেজের সামনে আসবে।

আক্ষেপ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে এই প্রবীণ মানুষটি বলেন, ‘আমি তো দৌড়াইতে পারি না। একদম সামনে আছিলাম। বেবাকে দৌড়াইয়া আইসা সামনে দাঁড়াইছে। এহন ৬০-৭০ জনের পিছে। গাড়ি এহেক দিন এহেক জায়গায় আহে কোনো তাল ঠিক নাই।

‘আবার কিছু লোক আছে এলাকার আইয়া জোর করি সামনে ঢুইকালায়। এডা আরও বড় সমস্যা। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াইয়া রইলাম। হেরাই আগে দিয়া লয়।’

আগের দিনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘কাইলকা সাড়ে ৭টায় আইসা দাঁড়াইছি। ১১টায় কয় গাড়ি আইব না। পরে হেইহান আবার দৌড় পাইরা আনন্দ হলে আইলাম। হেইহানে যাইয়া দাঁড়াইয়া পরে দেড়টায় বাসায় গেছি।’

তিনি বলেন, ‘সময়টা ঠিক করা উচিত। জায়গাটা ঠিক করা উচিত।’

চাহিদা যত, পণ্য সরবরাহ তার চেয়ে কম

আমিনুল নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘প্রতিদিন আসে না। আজকে তো মালই নাই। অর্ধেক মানুষ পাবে। অর্ধেক মানুষ পাবে না।’

টিসিবির পণ্য আরও বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রৌদ্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাইকা যদি মাল না পাই তাইলে কষ্ট না? আমরা তো দুই পয়সা আয়ের লাইগাই দাঁড়াইছি। কষ্ট হইলেও লাইনে থাইকা নিতে হয়।’

কত টাকা সাশ্রয়

টিসিবির ট্রাকে এখন চাহিদার তুঙ্গে সয়াবিন তেল। আরও বিক্রি হয় পেঁয়াজ, ডাল, চিনি।

চারটি পণ্য কিনলে বাজারের চেয়ে প্রায় ৩৪০ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য এই টাকাটা কম নয় কোনো বিবেচনাতেই। তাই চাহিদা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

একেকজন ক্রেতাকে সয়াবিন তেল দেয়া হচ্ছে ২ লিটার করে। দাম ১১০ টাকা। বাজারদর ১৬৮। এখানে সাশ্রয় ১১৬ টাকা।

ট্রাকে পেঁয়াজ চাইলে পাঁচ কেজি করে কিনতে পারেন একেকজন। দাম ৩০ টাকা করে। যে পেঁয়াজ ট্রাকে দেয়া হয়, সেটির বাজারদর কমসে কম ৪৫ টাকা। পাঁচ কেজিতে সাশ্রয় ৭৫ টাকা।

চিনির দর এখন ৮০-৯০ টাকা কেজি। তবে টিসিবি বিক্রি করে ৪৫ টাকা করে। একেকজন নিতে পারে দুই কেজি করে। এখানে সাশ্রয় ৭০ থেকে ৯০ টাকা।

আর যে ডাল টিসিবি দেয় ৬০ টাকা কেজি, সেটির বাজারদর ৯০ টাকার কম নয়। একেকজন নিতে পারেন দুই কেজি, এখানে সাশ্রয় ৬০ টাকার মতো।

কলাবাগানের বাসিন্দা আব্দুর রব বলেন, ‘তেলের দাম ১৬০ টাকা। চাল ৬০-৭০ টাকা। একটা কপির দাম ৫০ টাকা। আমরা কী করি বাঁচুম? ছেলেপেলের হয় নাই চাকরি।’

এবারই প্রথম টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে (গ্রাম) চইলা যামু। ঢাকায় থাকা কঠিন হইয়া গেছে। আর পারতেছি না।’

লাইনে যারা, ‘তারাই দোষী’

টিসিবির ট্রাক সেলের ব্যবস্থাপনায় এই সংকটের বিষয়টি জানালে টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির দায়ী করলেন তাদেরকেই, যাদেরকে লাইনে দাঁড়িয়ে হয়রান হতে হয়, দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই জিনিসগুলো যারা বলে, সে কালকে আইসা পণ্য নিয়া গেছে; আজকে বাজারে বিক্রি করবে। সে হয়তো আবার নেবে এ জন্য অভিযোগটা করে।’

একেক দিন একেক এলাকায় পণ্য দেয়ার ‘সুবিধা’ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যদি একই জায়গায় দেয়া হয়, তাহলে তো শুধু সেই এলাকার লোকরাই সুবিধা পেল। আশপাশের লোকজন পেল না। এ জন্য সাড়ে চার শ জায়গায় পর্যায়ক্রমে দিই।

টিসিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়েবসাইটে আগের দিন রাতে আপলোড করে দিই। সকালবেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দেখে নিতে পারে।’

পণ্য আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা পণ্য বাড়াতে বাড়াতে এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে আসছি। গত মাসে ঢাকা সিটিতে ট্রাক দিয়েছি ৭০ থেকে ৭৫টি। এই মাসে ট্রাকের সংখ্যা ডাবল করে ফেলেছি। আর কত বাড়াব? তাহলে তো দুই কোটি মানুষের ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে।’

টোকেন সিস্টেম করা যায় কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তখন তো আপনারা লিখবেন নিজস্ব পরিচিত গণ্ডির মধ্যে টোকেন সিস্টেম করেছে।’

তবে ঢাকার বাইরে কার্ডের মাধ্যমে পণ্য দেয়া হচ্ছে বলে জানালেন হুমায়ুন কবির।

পণ্য বিক্রির নির্দিষ্ট সময় আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে শুরু করে পণ্য শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে গাড়িগুলো গুদাম থেকে সাড়ে ৭টায় বের হয়। ঢাকায় দুটি গুদাম, নারায়ণগঞ্জে একটি। গুদাম থেকে গাড়ি বের হতে একেকটির ৭ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগে। সর্বশেষ গাড়ি বের হতে কখনও সাড়ে ১২টা বেজে যায়। এ জন্য একেক এলাকায় একেক সময় যায়।’

এ বিভাগের আরো খবর