বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শুধু আশ্বাস, মেলে না সেতু

  •    
  • ৫ মার্চ, ২০২২ ১২:৫৩

আক্ষেপ নিয়ে স্থানীয় জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এপারে আবার ধরলে বর্ষাকালে লেংটি মাইরা আইতে হয়। পোলাপান স্কুলে যাবার পাই না। আমরা কৃষি আবাদ করে ফসল বাজারে তোলা পাই না। আমরা ছোট থাইক্কা দেখতাছি, এই নদীর মধ্যে সাঁকো আর নৌকা। কত যে উপজেলা চেয়ারম্যান গেল, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গেল, মেম্বার গেল কেউ আমগর দুঃখ বুঝল না। খালি ভোটের সময় আইলে এইবার করমু কইয়া ভোট নেয়। ব্রিজ আর কইরা দেয় না।’

ভোট আসে, ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে আসেন জনপ্রতিনিধি হতে। স্বপ্ন দেখান ভোটে জিতলে লাঘব হবে জনসাধারণের দুর্ভোগ, ঘুচবে দুঃখ-দুর্দশা, থাকবে না কেউ অবহেলিত, দেখা হবে কার কী সমস্যা। ভোট যায়, আবার ভোটের সময় আসে; ভোট চাইতে আসেন নতুন কেউ। এভাবে আশ্বাসের পর আশ্বাস মেলে, হয় না বাস্তবায়ন।

এই আশ্বাসে আশ্বাসে দিনের পর বছর, যুগের পর যুগ পার হলেও একটি সেতু মেলে না নীলফামারীর জলঢাকা ও শেরপুরের নালিতাবাড়ীর বাসিন্দাদের। এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই তাদের। তাই আর আশ্বাস নয়, বাস্তবায়ন চায় তারা।

‘অনেকে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু ব্রিজ আর হয়নি’

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের বুড়িতিস্তা নদীর মনসারের ঘাট এলাকা ব্যবহার করে চলাচল করেন ডাউয়াবাড়িসহ শৌলমারী, গোল্ডমুণ্ডা ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার হলদিবাড়ি এলাকার লাখো মানুষ।

কিন্তু চার যুগেও বুড়িতিস্তা নদীতে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে এখানকার জনসাধারণ।

সেতু নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আশ্বাস দেয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আক্ষেপের শেষ নেই স্থানীয়দের। আর একটি সেতুর অভাবে অনেকটাই পিছিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কার্যক্রম ও কৃষি।

বছরজুড়ে নদীতে পানি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে নিজেদের তৈরি কাঠ ও বাঁশের সাঁকোটি দিয়ে সাইকেল, রিকশা, ভ্যান কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াত করলেও ভারী যানবাহনগুলো যেতে হয় নদী বেয়েই।

তবে দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায় বর্ষা মৌসুমে। এ সময় একমাত্র নৌকা ছাড়া উপায় থাকে না স্থানীয়দের।

চরভরট এলাকার দশম শ্রেণির ছাত্র আলমগীর হোসেন বলে, ‘বর্ষাকালে আমাদের প্রায়ই স্কুলে যেতে দেরি হয়। ঘাটে নৌকা না থাকায় ঠিক সময়ে নদী পার হওয়া যায় না। ফলে অনেক সময় ক্লাসও মিস হয়। আবার হাত থেকে বই নদীতে পড়ে ভিজে যায়।’

এই ঘাট দিয়ে চলাচল করেন গোলমুণ্ডা ইউনিয়নের হলদিবাড়ি এলাকার জামিয়ার রহমান। তিনি বলেন, ‘কেউ অসুস্থ হলে বিপদে পড়তে হয়। বর্ষাকালে সন্ধ্যায় নৌকা বন্ধ হয়ে যায়। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের কাছে কিংবা হাসপাতালে যাওয়া দরকার- এমন পরিস্থিতিতে পল্লী চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।’

এ বিষয়ে ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘জনদুর্ভোগ অত্যন্ত চরমে। এখানে জরুরি ভিত্তিতে একটি সেতু নির্মাণ করা দরকার। এই এলাকার মানুষ বাঁশের সাঁকোতে কষ্টে চলাচল করছে। আসছে বর্ষায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।’

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘চরাঞ্চল হওয়ায় এবং সেতু না থাকার কারণে এই এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ হচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় মানুষের জীবন যাত্রারও পরিবর্তন হচ্ছে না।

‘যারা এই এলাকায় থাকেন তারাই শুধু এখানকার মানুষের কষ্ট বোঝেন। অনেকে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু সেতু আর হয়নি।’

নীলফামারী-০৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এমপি থাকাকালীন মহান জাতীয় সংসদে কয়েকবার মনসার ঘাটে ব্রিজ নির্মাণের জন্য কথা তুলেছিলাম। ফলে সেখানে নদী বিশেষজ্ঞ এসে পরিদর্শন করে যান।

‘সামাজিক, অর্থনৈতিক, কৃষি ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে, এমনকি সয়েল টেস্টও হয়েছে। ব্রিজের জন্য স্থানীয়রা আন্দোলনও করেছিল, আমি তাদের আশ্বস্ত করেছিলাম।’

ওই এলাকার বাসিন্দা ও জলঢাকা উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব মমিনুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘নেকক্ত, চরভরট, সিদ্ধেশ্বরী, ডাউয়াবাড়ি গ্রাম, শৌলমারী ইউনিয়নের দক্ষিণ চরভরট, আলসিয়াপাড়া, গোলমুণ্ডা ইউনিয়নের হলদিবাড়ি, ঘোড়ামারা ও সিদ্ধিসিড়ি গ্রামের মানুষজন জলঢাকা উপজেলা সদরে যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।

‘পাশাপাশি হাতিবান্ধা উপজেলার কিছু মানুষও এই ঘাট ব্যবহার করে থাকে। অথচ চার যুগেও এখানে সেতু নির্মাণ হয়নি।’ তাই সেখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগের দাবি জানান তিনি।

ওই এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে জানিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেখানে সেতুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বলা হয়েছে এবং প্রকল্পও দেয়া হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হয়ে এলে সেখান কাজ শুরু করা হবে।’

জনদুর্ভোগের কথা স্বীকার করে জলঢাকা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহেদ বাহাদুর বলেন, ‘এলজিইডির সঙ্গে সমন্বয় করে সেখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেটি অনুমোদন হয়ে এলে কাজ শুরু হবে।’

‘মরার আগে ব্রিজ দেইক্কা যাবার পামু কি না জানি না’

শেরপুর সদর, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী এই তিন উপজেলার সংযোগস্থল নালিতাবাড়ী উপজেলার কলসপাড় ইউনিয়নের মালিঝি নদীর শাখা কলস নদী। তিন উপজেলার সীমানা হওয়ায় কারোর দৃষ্টি নেই এ এলাকার মানুষের নানা সমস্যার দিকে।

নালিতাবাড়ী উপজেলার কলস নদীর ওপর একটি সেতু না থাকায় নিজেদের তৈরি একটি বাঁশের সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হতে হয় এখানকার ১৫ গ্রামের অন্তত ৩০ হাজার মানুষের।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর একপারে নালিতাবাড়ীর কলসপাড় ইউনিয়নের কলসপাড় গ্রামে অবস্থিত পশ্চিম কলসপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলসপাড নঈমি দাখিল মাদ্রাসা, মোহাম্মাদিয়া কওমি মাদ্রাসা এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীরা যাতায়াত করেন এ নদী দিয়ে।

স্থানীয়দের দাবি, এখানে একটি সেতু হলে বদলে যাবে এখানকার জীবনযাত্রা। আর এ দাবিতে তারা নদীর পাড়ে মানববন্ধনও করেছেন।

ঝিনাইগাতীর মালিঝিকান্দা ইউনিয়নের আরশাদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বাড়ি বাড়ি গিয়া কাঁচামালের (পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন) ব্যবসা করি। নদীর ওপর এডা ব্রিজ অইলে (হলে) আমাগর খুব সুবিধা অইত। ভার নিয়া আর কত আমরা এই এক পায়ের ব্রিজ দিয়া যামু।’

নালিতাবাড়ীর কলসপাড়ের গ্রামের বাসিন্দা আবু সামা বলেন, ‘এই ব্রিজটা হইলে আমাদের দুই উপজেলার মানুষের যোগসাজশ হইত। এই ব্রিজের দুই পাশেই পাকা রাস্তা আছে। মাঝখানে এই ব্রিজের জন্য অল্প কিছু কাঁচা রাস্তা। এই ব্রিজটা হলে আমাদের বাজারঘাট করতে খুব সুবিধা হইত।’

আবেদা বেগম বলেন, ‘আমরা নদীর এপারের ঝিনাইগাতীর লোক। আমাদের গ্রামেও একটা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে। কিন্তু এইটাতে আমরা চিকিৎসা নিতে পারি না। কারণ ওই দিকে কোনো রাস্তা নাই।

‘তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও নৌকা বা সাঁকো দিয়া নদী পার হয়ে ওপারে চিকিৎসা নিতে হয়। আর এখানে একটা ব্রিজ হইলে নালিতাবাড়ীর কলসপাড় ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া সুবিধা হইত।’

পশ্চিম কলসপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বাছিরুন নাহার বলে, ‘আমি নদীর ওপারে স্কুলে পড়ি। কিন্তু আমগর অসুবিধা হয় স্কুলে আইতে। স্কুলে আবার ধরলে নদীত পইড়া জাইগা। নদীত পড়ে গেলে তো বইগুলাও ভিজে যায়। আর বই নষ্ট হয়ে গেলে তো আর পাওয়া যাই না। আমরা চাই আমাদের এলাকায় একটা ব্রিজ হোক।’

নালিতাবাড়ীর কলসপাড নঈমি দাখিল মাদ্রাসা সুপার আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসে নদীর ওপার থেকে, তাই শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে হলেও দ্রুত একটি ব্রিজ নির্মাণ করা দরকার।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, ভোটের সময় হলেই চেয়ারম্যান মেম্বারগণ এ সমস্যার আশ্বাস দেন। কিন্তু নির্বাচনের পর আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয় না।

করিম মিয়া বলেন, ‘আমার বয়স ৬০ বছর। জন্মের পর থাইক্কা তো দেখতাছি এনো সাঁকো আর সাঁকো। আমগর এলাকা কৃষি এলাকা। নদীর ওপাড়ে বাজার আছে। বাজরে আমরা তো মালামাল পারাপার কইরা নিতে পারি না। আমরা মেম্বার, চেয়ারম্যানদের কাছে মেলা গেছি, কোনও কাম হয় নাই। তাদের কাছে গেলে বলে আমাদের হাত নেই। আমরা মরার আগে ব্রিজ দেইক্কা যাবার পামু কিনা জানি না।’

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এপারে আবার ধরলে বর্ষাকালে লেংটি মাইরা আইতে হয়। পোলাপান স্কুলো যাবার পায় না। আমরা কৃষি আবাদ করে ফসল বাজারে তোলা পাই না। আমরা ছোট থাইক্কা দেখতাছি এই নদীর মধ্যে সাঁকো আর নৌকা।

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কত যে উপজেলা চেয়ারম্যান গেল, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গেল, মেম্বার গেল কেউ আমগর দুঃখ বুঝল না। খালি ভোটের সময় আইলে এইবার করমু কইয়া ভোট নেই। ব্রিজ আর কইরা দেয় না।’

এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস নবনির্বাচিত নালিতাবাড়ী কলসপাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদের। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই ইউনিয়নের মানুষের দুর্ভোগের কারণ কলস নদী। নদীর ওপারের যে লোকগুলো আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক। এ নদীতে একটি সেতু দরকার। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’

শেরপুর জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ বলেন, ‘বিষয়টি কেউ আমাদের নজরে আনেননি। আপনাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম। আমরা এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে নিদের্শনা দেয়া হবে।’

কলসপাড় ইউনিয়ন, কলসপাড় গ্রাম, মালিঝি নদী প্রবাহিত হয়ে এখানে এসে কলস নদী হয়েছে। এই নদীর ওপর ১৫০ ফুট দীর্ঘ একটি সেতু হলে বদলে যাবে এখানকার জীবনযাত্রা, উন্নয়ন হবে ব্যবসা বাণিজ্যের, নতুন করে স্বপ্ন দেখবেন এলাকার মানুষ। তাই আশ্বাস নয়, দ্রুত একটি সেতু নির্মাণ হবে, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

এ বিভাগের আরো খবর