বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দেশের ওষুধশিল্প ঘুরে দাঁড়াল যেভাবে

  •    
  • ৫ মার্চ, ২০২২ ০৮:৩০

‘একসময় ওষুধে অভাবগ্রস্ত বাংলাদেশ এখন বিশ্বকে ওষুধ দেয়। ওষুধের জন্য বিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে– এটি ভাবলেই মনে গর্ব হয়। আসলেই অধিক মূল্য সংযোজনকারী ওষুধশিল্প আমাদের গর্বের বিষয়।’

একসময় সাত-আটটি দেশীয় কোম্পানি সিরাপ, ভিটামিন, মিকশ্চার, টনিকসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বানাত। স্থানীয় কোম্পানিগুলোয় ছিল না আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়ো-কেমিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট।

অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে-পরে দেশে ওষুধের বাজার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। নানা অজুহাতে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম তারা বাড়াতেই থাকত, যা কেনার সামর্থ্য হতো না সংখ্যাগরিষ্ঠের।

ওষুধ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ওষুধের জন্য বাংলাদেশকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে বিশ্বের দিকে। মুদ্রার রিজার্ভ না থাকার অজুহাতে ইউরোপ-আমেরিকার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে ওষুধ দেয়নি। বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির সঙ্গে বিনিময় চুক্তি করে পাট ও অন্যান্য পণ্যের বিনিময়ে দেশে ওষুধ আনতে হয়েছে।

পাঁচ দশকের ব্যবধানে এ চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন ওষুধ রপ্তানিকারী দেশ।

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে ওষুধশিল্প পার্কে নির্মাণযজ্ঞ। ছবি: নিউজবাংলা

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির (বিএপিআই) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ওষুধ উৎপাদনের জন্য নিবন্ধিত কোম্পানি ২৮৪টি। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক উৎপাদনে রয়েছে ২১৪টি। উৎপাদিত ওষুধের ৮০ শতাংশ জেনেরিক এবং ২০ শতাংশ পেটেন্টেড। সংখ্যার হিসেবে জেনেরিক ওষুধের উৎপাদন ৩০ হাজারের বেশি। আর ১২ হাজারের বেশি আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হারবাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে দেশে।

শুধু তা-ই নয়, একসময় যে ইউরোপ-আমেরিকা বাংলাদেশকে ওষুধ দেয়নি, এখন সেই দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের ১৫৩টি দেশকে তিন শতাধিক জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সরবরাহ করছে বাংলাদেশ।

স্থানীয় ওষুধের বাজারও বড় হয়েছে। ৭ কোটি থেকে এখন ১৭ কোটি মানুষের ওষুধের বাজার এটি। স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ তৈরিসহ স্থানীয় বাজারের ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে। আমদানি হচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তির মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ।

১৯৭২ সালে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। তখন ৯০ শতাংশ ওষুধ ছিল আমদানি করা। স্থানীয় ওষুধশিল্পের ক্রমবিকাশের ফলে ২০১২ সালে ওষুধের বাজার বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকার। ২০১৯ সালে তা ২৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর ২০২১ সালের হিসাবে অভ্যন্তরীণ বাজার দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকায়।

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিকদের সমিতি (বিএপিআই) মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। তবে আমরা মনে করি, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন ও গর্বের ধন হলো ওষুধশিল্পের অভাবনীয় বিকাশ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ মজিদ বলেন, ‘একসময় ওষুধে অভাবগ্রস্ত বাংলাদেশ এখন বিশ্বকে ওষুধ দেয়। ওষুধের জন্য বিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে– এটি ভাবলেই মনে গর্ব হয়। আসলেই অধিক মূল্য সংযোজনকারী ওষুধশিল্প আমাদের গর্বের বিষয়।’

নির্মাণাধীন ওষুধ শিল্প পার্কে একটি কোম্পানির কর্মকাণ্ড। ছবি: নিউজবাংলা

দেশের প্রায় সব ওষুধ কোম্পানির রয়েছে জিএমপি (খাদ্য ও স্বাস্থ্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বিশ্বস্বীকৃত মান) স্বীকৃতি। স্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ভান্ডারে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে ইউএসএফডিএ, ইউকে এমএইচআরএ, ইইউ জিএমপি, হেলথ কানাডা, টিজিএ অস্ট্রেলিয়া, অ্যানভিসা ব্রাজিল, জিসিসি স্বীকৃতি।

ধারাবাহিক উন্নতির স্তরে দেশে ওষুধশিল্প এখন জেনেরিক ফর্মুলেশন ডেভেলপমেন্টে তার উচ্চতর গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই বিশেষায়িত, উচ্চপ্রযুক্তির ফর্মুলেশনগুলোর সফল বিকাশের মাধ্যমে দেশ তার দক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

নেতৃস্থানীয় কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরিতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বিশেষ ডোজ ডেলিভারি সিস্টেমের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা সফলভাবে মিটারড ডোজ ইনহেলার, ড্রাই পাউডার ইনহেলার, লাইওফিলাইজড ইনজেক্টেবল, জীবাণুমুক্ত চক্ষুবিদ্যা, প্রিফিলড সিরিঞ্জ, ওরাল থিন ফিল্ম, মাল্টি-লেয়ার ট্যাবলেট ও জৈবিক পণ্য তৈরি করছে। ইনসুলিন, ভ্যাকসিন ইত্যাদিসহ হাইটেক ওষুধও তৈরি হচ্ছে দেশে।

দেশে ওষুধশিল্পে সাফল্যের চিত্র উঠে এসেছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ২০২১ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিবেদনেও।

ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধের পরিমাণ ও গুণগত মানের উন্নতির অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়েছে।

ওষুধশিল্পের বিকাশ যেভাবে হলো

বিশিষ্ট ফার্মাসিস্ট ও কেমিস্ট ড. এম এ মজিদ জানান, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্থানীয় ওষুধ কারখানাগুলো এত রুগ্‌ণ ছিল যে তারা চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ তৈরি করত। ১৯৮১ পর্যন্ত চিত্রটি এ রকমই ছিল। দেশে ওষুধশিল্প বিকাশের এই ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতি, যেটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘দ্য ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ও ড্রাগ পলিসি’।

ড. এম এ মজিদ বলেন, ‘জাতীয় ওষুধনীতির বাস্তবায়নে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হওয়ার পর নতুন নীতি ও আইনে যে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়, তখন থেকেই দেশে বিদেশি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া প্রভাব কমতে থাকে। এতে তাদের মুনাফায় ধারাবাহিক ভাটা পড়তে থাকে এবং এক এক করে তারা কারখানা বিক্রি করে চলে যেতে থাকে। এ তালিকায় সবশেষ যুক্ত হয় গ্ল্যাকসো স্মিথক্লাইন ও সানোফি-এভেনটিস।

এর ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং সব ধরনের ওষুধের স্থানীয় উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে অতি জরুরি ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং মানহীন ওষুধ তৈরির প্রবণতাও কমে যায়। ওষুধের দাম নির্ধারণের আইন করা হয়, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ওষুধ প্রেসক্রিপশন বন্ধ করা হয়।

দেশে ওষুধ বিশেষজ্ঞ তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৪ সাল থেকে ফার্মাসি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা চালু হয়। ফার্মাসিস্টের পেশাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে ফার্মাসি অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে। তবে গড়ে ওঠা এ দক্ষ জনবলকে স্বাস্থ্যসেবার কোনো সেক্টরে কাজের সুযোগ দেয়া হতো না। ফলে গ্র্যাজুয়েশন শেষে সবাই বিদেশমুখী হতেন, যা ছিল দেশের জন্য আরেক অপূরণীয় ক্ষতি।

ওষুধশিল্প পার্কে একটি প্রতিষ্ঠানের ল্যাব

ড. এম এ মজিদ আরও জানান, বর্তমানে দেশে ওষুধের উৎপাদন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বাজার সম্প্রসারণ ও বিকাশে দক্ষ পেশাজীবীদের রয়েছে বিরাট অবদান। এর সূচনা ঘটেছিল ১৯৮২ সালের নতুন ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনে ওষুধশিল্পে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বাধ্যবাধকতা জারির মাধ্যমে। এরপর ফার্মাসিস্ট ও কেমিস্টদের দেশেও লোভনীয় কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়।

বিএপিআই মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামানও একই সুরে বলেন, ‘১৯৮২ সালের ওষুধনীতির পর থেকেই ওষুধশিল্প ক্রমে বড় হচ্ছে।’

একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান সিনহা বলেন, ‘১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি আমরা না পেলে স্থানীয় ওষুধশিল্পের এত প্রসার ঘটানো হয়তো সম্ভব হতো না। এখনও আমাদের বহুজাতিক কোম্পানির দ্বারস্থ হয়েই থাকতে হতো।’

সিনহা আরও বলেন, দেশে ওষুধশিল্পের বিকাশে সরকার যে সহযোগিতা করেছে, তার সবশেষ বড় ক্ষেত্র হচ্ছে উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক এপিআই পার্ক করে দেয়া। এ ছাড়া নানা রকম কর সুবিধার মাধ্যমেও সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে যাচ্ছে।

এ বিভাগের আরো খবর