রোগীর সঠিক সেবা নিশ্চিতে শব্দদূষণ কম হয় এমন জায়গায় নির্মিত হয়েছিল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল। পরে শব্দদূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ছাড়িয়েছে এসব হাসপাতালের সামনের রাস্তাতেও।
সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে এসেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ইকিউএমএস কনসালটিং লিমিটেডের যৌথ এক গবেষণায়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘আন্তর্জাতিক শ্রবণ দিবস’ উপলক্ষে এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রকাশ করা হয়।
‘প্রাণ-প্রকৃতির ওপর শব্দ দূষণের প্রভাব ও প্রতিকার’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘গবেষণার জন্য রাজধানীর ১৭টি হাসপাতাল নির্বাচন করা হয়। এ গবেষণায় এসব হাসপাতালে সামনের রাস্তায় শব্দদূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ ৮৯ দশমিক ৯ ডেসিবল। দিনের বেলায় নীরব এলাকার জন্য আদর্শ মান ৫০ ডেসিবলের চেয়ে, যা অনেক বেশি।’
আমেরিকান স্পিস অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী ৭১ থেকে ৯০ ডেসিবল মাত্রায় শব্দ তীব্রতর শব্দদূষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জানান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল এ বছরের মার্চের প্রথমদিকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ব্যবহারের ভিত্তিতে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। গবেষণার অংশ হিসেবে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ১৭টি হাসপাতালের সামনের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
তিনি জানান, প্রতিটি হাসপাতালের সামনে শুধু কর্মদিবসে মোট এক ঘণ্টার শব্দের উপাত্ত তাইওয়ানে তৈরি লুট্রন ব্র্যান্ডের স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল মেশিনের সাহায্যে রেকর্ড করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া যায়।
কামরুজ্জামান জানান, মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে বোঝা যায়, ধানমন্ডিতে বেশিরভাগ হাসপাতালগুলোর অবস্থান ব্যস্ত ট্রাফিক সংযোগের পাশে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকার জন্য দিনের বেলায় নির্ধারিত আদর্শ মান মাত্রা ৫৫ ডেসিবল। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত হাসপাতালগুলোর সামনে শব্দের মাত্রার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৭টি জায়গাতেই আদর্শ মান পার হয়েছে।
তিনি জানান, আদর্শমান অতিক্রান্তের পরিমাণ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের সামনে ২৪ দশমিক ৭ ভাগ (৬৯ দশমিক ৭ ডেসিবল) যা ১৭টি স্থানের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে ৩৪ ভাগ (৮৯ দশমিক ৯ ডেসিবল) যা ১৭টি স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে, হাসপাতালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী নীরব এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে দিনের বেলার নীরব এলাকার মান (৫০ ডেসিবল) মাত্রার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখা যায় যে, ১৭টি স্থানের মধ্যে শব্দের মাত্রা গড়ে ৮১ দশমিক ৭ ডেসিবল। এর মধ্যে নয়টি স্থানেই ৮০ ডেসিবলের উপরে শব্দের মাত্রা রয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক মাত্রা।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, ‘শব্দ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। একেক ধরনের প্রাণীর শ্রবণসীমা একেক রকম। ফলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের ফলে তার দিশেহারা হয়ে যায়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘সব স্তরের মানুষকে যুক্ত করে শব্দদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। হাইড্রলিক হর্ন বাজানো নিষেধের আগে এর বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শব্দদূষণ গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ডাটাবেজ সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রাণ প্রকৃতির ওপর শব্দ দূষণের প্রভাব রয়েছে। যেসব এলাকায় শব্দদূষণ বেশি, ওই এলাকা থেকে প্রাণীরা অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। ফলে উদ্ভিদের পরাগায়ণ ও প্রজনন ব্যাহত হয়।’
শব্দদূষণ রোধে ১০ সুপারিশ
ওয়েবিনার থেকে শব্দদূষণ রোধে ১০ দফা প্রস্তাবনা দেয়া হয়। এগুলো হলো, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬-এর শতভাগ বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতায় পরিবেশ ক্যাডার ও পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে, বিধিমালা সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনগুলোতে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করা ও সেটি মানার বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা।
একই সঙ্গে প্রস্তাবনায় হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ নিশ্চিত করা, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন না করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি, চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করা এবং শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ছাদ, বারান্দা, খোলা জায়গায় গাছ লাগানো (গাছ শব্দ শোষণ করে) এবং সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনি তৈরি করা এবং সন্ধ্যার পর ছাদ ও কমিউনিটি হলে গান-বাজনা না করা, ব্লেন্ডার, প্রেশার কুকার ও ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার না করা, ড্রিল ও গ্রাইন্ডিং মেশিনের ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগ নেয়া যাতে পারে।