দৈনিক প্রথম আলো ও একই গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, ‘এই পত্রিকা দুটি ম্যাজিশিয়ান (যাদুকর) ইয়েলো জার্নালিজম (সাংবাদিকতা) করে।’
সদ্য অপসারিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে নিয়ে লেখার কারণে সোমবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মুস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানিতে তিনি এই মন্তব্য করেন।
শুনানি শেষে আদালত দুই রিটকারি আইনজীবী এবং দুদক আইনজীবীকে লিখিত বক্তব্য দাখিলের জন্য আগামী ৮ মার্চ দিন ঠিক করে দেয়।
দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের অপসারণ এবং তার বিষয়ে তদন্ত চেয়ে করা রিটের শুনানিকালে দুদক আইনজীবী খুরশীদ বলেন, ‘প্রথম আলো বাংলাদেশে ম্যাজিশিয়ান জার্নালিজম করে, ডেইলি স্টারও তার কাছাকাছি করে।
“দেখেন পত্রিকার রিপোর্ট কী বলছে, ‘ভুমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির তদন্তে নেমে বিপদে তিনি’। ওনি কে? ওনি সেই শরীফ উদ্দিন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে দুদক থেকে অপসারণ করা হয়, ১৭ ফেব্রুয়ারি তার পক্ষে মানববন্ধন করে, আর ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে হট কেক। শিরোনাম, ‘ভুমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির তদন্তে নেমে বিপদে তিনি।’
“এই তিনি হচ্ছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা (অপসারণকৃত) শরীফ উদ্দিন। প্রথম আলোতে রিপোর্ট, এরপর তৃতীয়পক্ষকে দিয়ে রিট করা। এর ফলে কী হলো, তার সমস্ত অপরাধগুলো ঢাকা পড়ে গেল।”
দুদক আইনজীবী বলেন, ‘প্রথম আলো এই রিপোর্টের ডেটা কোথায় পেল, কার থেকে পেল, কীভাবে পেল? একইসঙ্গে রিট পিটিশনে যে সব ডকুমেন্টস তারা দিয়েছেন, তারা এসব কোথায় পেলেন। এগুলো তো অফিসিয়াল ডকুমেন্টস।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতেই পারে। কিন্তু এটাকে যাচাই করতে হবে। আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়া যখন এসব বিষয়ে নিউজ করে তখন তারা চারটা ফোকাল পয়েন্ট থেকে যাচাই করে। প্রথম আলোর এই রিপোর্টে সেই অ্যানালাইসেস নাই।’
শরীফের অপসারণ নিয়ে রিটকারীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেন দুদক আইনজীবী।
তিনি বলেন, ‘দুদক তার ইমেজ রক্ষা করতে এই কর্মকর্তা (শরীফ উদ্দিন)কে অপসারণ করে দিয়েছেন। এটা আইন অনুযায়ী করা হয়েছে।’
পাল্টা জবাবে রিটকারীদের আইনজীবী শিশির মনির আদালতে বলেন, ‘আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দুদক তার কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করেছে। এ কারণেই আমরা রিট করেছি। রিটের পক্ষে কম করে হলেও ১০০ রায় নজির হিসেবে দেখানো যাবে।’
তিনি বলেন, ‘দুদক যে রুলস ফলো করে তাকে (শরীফ) অপসারণ করেছে, এই রুলসের সংজ্ঞায়ও তা পড়ে না। চারিত্রিক স্খলন, ঘুষ গ্রহণ, সামাজিক অবজ্ঞা, অসামাজিক কার্যকলাপসহ কোনো অভিযোগই তো তার বিরুদ্ধে নেই। তবে কেন তাকে অপসারণ করা হবে?’
এ সময় আদালত বলেন, ‘এই কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগ করছেন দুদক আইনজীবী।’
জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি কিছু অর্জন করেছেন, বা অর্থ গ্রহণ করেছেন এমন তো কোনো রেকর্ড আমরা পাচ্ছি না।’
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের খবর নিয়ে দুদক আইনজীবীর জবাবে রিটকারী এ আইনজীবী বলেন, ‘পত্রিকার এই রিপোর্ট নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে বলতে হয় আগে জানতে হবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা স্বাধীন গণমাধ্যমের একটি অংশ। যদি তিনি স্বাধীন গণমাধ্যমের মতকে উপেক্ষা করেন তাহলে আমার কিছু বলার নাই। সাংবিধানিক অধিকার তিনি যদি কেড়ে নিতে চান, তাহলে আমার স্যরি বলা ছাড়া আর কিছু বলার নাই।’
শিশির মনির বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে অপসারণকৃত দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের তদন্ত চেয়েছি। আমরা তো শুধুমাত্র শরীফ সাহেবের জন্য রিট করি নাই। কোনো ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে বা বিপক্ষে আমরা নই। আমাদের ব্যক্তিগত কোনো অসৎউদ্দেশ্যও নাই।
‘আমাদের কথা হচ্ছে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ উঠেছে সেটি পরিষ্কার হোক। সেজন্য আইনে যতটুকু সুযোগ দেওয়া আছে আমরা তার ব্যবহার চাচ্ছি।’
রিটকারী আইনজীবীর পাল্টা জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কতটুকু যেতে পারবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা মানে এটা না যে একতরফা যাবে। শরীফকে নিয়ে প্রথম আলোর প্রত্যেকটা রিপোর্টে একতরফা হয়েছে।
‘দুদক সচিব সেই তার দপ্তরে একটা সংবাদ সম্মেলনে করে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। সেখানে তিনি এটাও বলেছেন, শরীফ যে ৩৩টা ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করেছেন, তার মধ্যে ২৫টি লিখিত আর ৮টা অলিখিত।
‘পরের দিন ডেইলি স্টারে তার এই বক্তব্য এসেছে, পাশাপাশি শরীফের বক্তব্য। এটা তারা করেছে খুবই কৌশলী হয়ে। ম্যাজিশিয়ান জার্নালিজমের আকারে। এ বিষয়ে কোর্টের যে আদেশ আছে তা স্পর্শও করেনি তারা। অথচ সচিব মহোদয় এ বিষয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
‘এটা কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা? আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এটাকে বলে ম্যাজিশিয়ান ইয়ালো জার্নালিজম।’
এই সাংবাদিকতার বিষয়ে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের উদ্দেশ্য কী, সে প্রশ্নও রাখেন দুদক সচিব। পরে নিজেই জবাব দিয়ে বলেন, ‘এটা দিয়ে তারা বুঝাতে চাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী যখন দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স, অথচ তার সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন কী করছে? ভালো তদন্ত কর্মকর্তাকে অপসারণ করে দিচ্ছে। এটাই ডেইলি স্টার, প্রথমআলো ও টিআইবির উদ্দেশ্য।
‘এটা খুবই ভয়ঙ্কর বিষয়। এটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। না হলে তারা কীভাবে টুইস্টিং জার্নালিজম করে? সচিব যেখানে বলে দিলেন হাইকোর্ট ব্যাংক একাউন্ট জব্দ অবৈধ ঘোষণা করেছে, ডেইলি স্টার পরের দিন সব কথা লিখেছে, অথচ এই অংশটুকু তারা বাদ দিয়ে দিল। এটা কি অনুন্ধানী সাংবাদিকতা?
‘অপসারণকৃত, দুর্নীতিবাজ, আদালতের আদেশ ভঙ্গকারী শরীফের বক্তব্য ছেপেছেন পাঁচ মিনিট, অথচ দুদকের সচিবের বক্তব্য ছেপেছেন ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ড। এ ধরনের সাংবাদিকতায় অনুৎসাহ দেয়া উচিত।’
পরে আদালত দুই পক্ষকে তাদের আরও বক্তব্য বা তথ্য দেয়ার থাকলে তা লিখিত আকারে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে ৮ মার্চ পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক পদ থেকে শরীফ উদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণের পক্ষে-বিপক্ষে আসা অভিযোগের তদন্ত চেয়ে ১০ আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের আজকে শুনানি হয়।
রিটকারী ১০ আইনজীবী হলেন শিশির মনির, রেজওয়ানা ফেরদৌস, জামিলুর রহমান খান, উত্তম কুমার বণিক, মুস্তাফিজুর রহমান, মো. তারেকুল ইসলাম, আহমেদ আব্দুল্লাহ খান, সৈয়দ মোহাম্মদ রায়হান, সাইফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নওয়াব আলী।