চারদিকে কাঁদছেন সবাই। প্রিয় নানু, খালাম্মা, মামা সবাই কাঁদছেন। মায়ের চোখেও পানি! ছোট্ট ঋদ্ধির বুঝতে বাকি নেই কেউ একজন মারা গেছেন। কিন্তু ‘কে মারা গেছে?’ মামা সম্পর্কীয় প্রান্ত সুশীলের কোলে ঋদ্ধির এমন প্রশ্ন।
নিউজবাংলাকে প্রান্ত বলেন, ‘ঋদ্ধিকে এখনো বলা হয়নি যে তার বাবা মারা গেছেন। সেও এখনো বুঝতে পারেনি। তাকে তার পছন্দের চিপস দিয়ে রাখা হয়েছে।’
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রক্তিম সুশীল। এ নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে পাঁচ সন্তান হারানো চকরিয়ার মালুমঘাট এলাকার মৃণালিনী দেবীর নিহত পুত্রের সংখ্যা দাঁড়াল ছয়-এ।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ওই দুর্ঘটনার ১০ দিন আগে মারা গিয়েছিলেন মৃণালিনীর স্বামীও। দুর্ঘটনার দিন মারা যান তার পাঁচ পুত্র- অনুপম সুশীল, নিরুপম সুশীল, দীপক সুশীল, চম্পক সুশীল ও স্মরণ সুশীল। একই দুর্ঘটনায় আহত আরেক পুত্র রক্তিমও মারা গেলেন ১৪ দিন পর।
রক্তিমের মৃত্যুর খবরটি চকরিয়ার মালুমঘাটে বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকে পাগলপ্রায় ছোট ভাই প্লাবন সুশীল। আর মা মৃণালিনী সুশীল মানু বিছানা থেকেই উঠতে পারছেন না। ৬৫ বছরের মৃণালিনীকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়- ‘ভগবান এ কেমন পরীক্ষায় ফেলেছেন? দুই বছর আগে এক ছেলেকে অকালে হারালাম। স্বামী হারানোর ১০ দিনের মধ্যে সব হারালাম। এখন ভগবান ছাড়া আমাদের দেখার কেউই থাকল না।’
তিনি বিলাপ করছিলেন, ‘যার জন্য প্রার্থনা করেছি, ভগবান তাকেও নিয়ে গেছেন!’
রক্তিমের মৃত্যুর বিষয়ে হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজি ও আইডিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রঞ্জন কুমার নাথ কাজল বলেন, ‘রক্তিমকে বাঁচানোর জন্য আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। শুরুতে তাকে ভর্তি করা হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জেনারেল হাসপাতালে মেডিক্যাল বোর্ড বসে তার চিকিৎসার জন্য। সেখানে কোনো উন্নতি না হওয়ায় ১৩ ফেব্রুয়ারি তাকে চমেকে নিয়ে আসা হয়। পরদিন এখানেও মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়।’
রঞ্জন কুমার জানান, ট্রমাটাইজড ছিলেন রক্তিম। তার মাথায় ছিল পলিট্রমা। পলি মানে অনেক, প্রতিটা জায়গায় তার ট্রমা ছিল। ট্রমাটাইজড রোগীরা অনেক জটিলতার মুখোমুখি হন। এর সঙ্গে ছিল হেডেঞ্জেনিক। মানে তার মাথার ভেতরে আঘাত ছিল। এটা অপারেশন করে কিছু করারও উপায় ছিল না।
এসব কারণেই জটিলতা বাড়তে থাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারির পর রক্তিমের জ্বর বেড়ে যায়। এতে যেখানে যেখানে ক্ষত ছিল, সব জায়গায় ইনফেকশন ছড়িয়ে যায়।
এ অবস্থায় আরেকটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেও শেষ পর্যন্ত রক্তিমকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের মালুমঘাট ফকিরশাহ এলাকায় মহাসড়ক পার হওয়ার সময় পিকআপ ভ্যানের চাপায় মৃত্যু হয় রক্তিমের পাঁচ ভাইয়ের। এ সময় আহত হন রক্তিম ও তার এক বোন। ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাদের আরেক বোন মুন্নী সুশীল।
মুন্নী বলেন, ‘আমরা সাত ভাই ও দুই বোন পিচঢালা রাস্তা থেকে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেপরোয়া পিকআপ ভ্যানটি দ্রুত এসে আমাদের চাপা দেয়। তখন আমি ও প্লাবন ছিটকে পড়ি। এ সময় দেখি পিকআপটি একটু পিছিয়ে গিয়ে আবারও চাপা দেয়। পরিকল্পিত না হলে এমনটি কেন হলো?’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘১৪ দিন পরও গাড়ির মালিককে ধরতে পারেনি পুলিশ। আমার তো সবকিছু রহস্যজনক মনে হচ্ছে।’
স্থানীয় টিটু চন্দ্র বলেন, স্বামী হারানোর পর ৬ সন্তানও চলে গেল। মৃণালিনী এত শোক সইবেন কী করে?’
শিমু দাশ নামে স্থানীয় আরেকজন বলেন, ‘এটি হয়তো মানু দিদির কপালে ছিল। ঘটনার রহস্য এখনো উন্মোচন হয়নি। এতে দায়িত্বশীল সবার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।’