‘হুন, আমাগো শ্যাখ ছাহাব আছিল বইলাই তো আমরা দ্যাশ পাইছি। না হইলে বি এহনও ওগো কামলা দিতা, বুঝঝো, এহন তো বি সাহাবের মতো দেহায় মিয়া তোমারে।’
কথাগুলো ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় বলছিলেন টীকাটুলির আদি বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী মান্নান শেখ।
কথাগুলো প্রমিত বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়– ‘শোন, আমাদের শেখ সাহেব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ছিলেন বলেই আমরা দেশ পেয়েছি। না হলে এখনও (পাকিস্তানিদের) শ্রমিকের কাজ করতে হতো, এখন তো তোমাকে সাহেবের মতো দেখায়।’
মান্নান শেখের পরিবারের মতো হাতে গোনা কিছু পরিবার এখনও নিজেদের আদি ভাষায় (কুট্টি) কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রাজীব হুমায়নের লেখা ‘পুরোনো ঢাকার ভাষা’ বই থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ভাষা মূলত দুই ধরনের। এর একটি ‘ঢাকাইয়া বাংলা’ এবং আরেকটি ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ নামে পরিচিত। এই ঢাকাইয়া উর্দুভাষীদের ‘সুব্বাস’ নামেও পরিচিতি আছে। কুট্টি ভাষাটি মূলত ‘ঢাকাইয়া বাংলা’। এটি বাংলা ও উর্দুর সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক ভাষা। এ ভাষা উচ্চারণে রয়েছে বিশেষ টান ও বলার স্বতন্ত্র ঢং।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কুট্টি ভাষা? এমন প্রশ্ন করেছিলাম পুরান ঢাকার একটি বনেদি পরিবারের সদস্য ও মাদার বখশ সরদার মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আজিম বখশের কাছে।
তার মতে, গত চার-পাঁচ দশকে পুরান ঢাকার একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে গেছে। অনেকে পুরান ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। আবার নতুন নতুন মানুষ বাস করা শুরু করেছে পুরান ঢাকায়। এটাই পুরান ঢাকার কুট্টি ভাষা হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ।
পরিবার থেকে সন্তানদেরও কুট্টি ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করা হয় না বলেও জানান তিনি।
বলেন, পরিবারের মা-বাবা মনে করেন এই ভাষায় কথা বললে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবে তার সন্তান। এ জন্যই তারা আধুনিক বাংলা ভাষা ও ইংরেজিতে কথা বলতে সন্তানদের উৎসাহিত করেন।
একই প্রশ্ন করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজা ইয়াসমীনের কাছে।
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকাইয়া বাংলা’ বাংলা ভাষারই একটি উপভাষা, যা কুট্টি ভাষা নামে পরিচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা একটা বড় কারণ। এ ছাড়া প্রমিত ভাষার কাছাকাছি এ ভাষাভাষীরা থাকছে বলেও এই উপভাষাটির স্বাতন্ত্র ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ভাষাটি রাজধানীতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই এটি বিভিন্ন উপভাষার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকাইয়া পরিবারগুলো এক সময় এনক্লোজড কমিউনিটি ছিল। এখন শিক্ষা, বিবাহসহ নানা কারণে তাদের প্রমিত বাংলাভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের ভাষায়। ফলে ঢাকাইয়া বাংলা ভাষার বিবর্তন হচ্ছে।’
এ ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত প্রকাশিতব্য বই ‘ঢাকাই কুট্টির চুটকি’র সংকলক ও সম্পাদক কবি মামুন রশীদ।
বলেন, ‘ভাষার বিবর্তনে কোনো কোনো ভাষা হয়ত টিকে থাকতে পারে না। কুট্টি বা সুখবাসী ভাষাও তেমনি টিকে থাকার লড়াই করছে। কুট্টি ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে আজ যে শঙ্কা, তার পেছনে মূল ভাষার সঙ্গে, শাসকের ভাষার সঙ্গে যোগাযোগের সেতু তৈরির ব্যর্থতা যেমন রয়েছে, তেমনি আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের আধুনিক হয়ে ওঠার প্রবণতাও রয়েছে।’
জনপ্রিয় কয়েকটি কুট্টি শব্দ
পোলা (ছেলে), মাইয়া (মেয়ে), পোলাপাইন (ছেলে-মেয়ে), হাছা (সত্যি), ক্যালা (কেন), কেমতে (কীভাবে), হুন (শোন), চা খাইয়া (চা খেয়ে), থন (থেকে), কল্লা (গলা) কদু (লাউ), মগর (কিন্তু), আমি বি (আমিও), দেহি (দেখি), যাইয়া (গিয়ে), যাইতেছি (যাচ্ছি), করমু (করব)।
ইতিহাসের পাতা থেকে
সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনোনীত বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি তার নৌবহর নোঙর করেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী সবচেয়ে উঁচু ভূমি চাঁদনীঘাটে। এ সময় তিনি সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে পত্তন করেন ঢাকার। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে এ অঞ্চলকে ইসলাম খাঁ ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নামকরণ করেন। তবে এ জনপথের মানুষ ‘ঢাকা’ নামটিই ধারণ করেন।
আঠারো শতকের মধ্যভাগে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা ছিল বাণিজ্যের এক অন্যতম কেন্দ্রস্থল। সে সময় শস্য হিসেবে চাল ছিল পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য।
চাল রপ্তানিকারকদের সবাই ছিলেন মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ধান সংগ্রহ করতেন। আর তা ঢেঁকিতে ভানার কাজে নিয়োগ করা হতো অসংখ্য স্থানীয় শ্রমিকদের। এসব ধান ভানার কাজে শ্রমিকরা আসতেন ঢাকার আশপাশের অঞ্চল থেকে।
নিজেদের ভাববিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ধান ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা কথা বলতেন ভিন্ন এক ভাষায়। মাড়োয়ারিরা এই শ্রমিকদের সংক্ষেপে ‘কুট্টি’ নামে ডাকতেন।