দুর্নীতি দমন কমিশনের অপসারিত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন চৌধুরীর বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইয়ুব খান চৌধুরীকে দেখতে পেয়েছে পুলিশ।
শরীফ উদ্দিনের অভিযোগ, আইয়ুব খান চৌধুরী তার বাসায় গিয়ে তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি কীভাবে চাকরি করেন, সেটিও দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এই অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় গত ৩০ জানুয়ারি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শরীফ উদ্দিন। এরপর ১৯ দিনে সেই জিডির তদন্ত শেষ করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি পুলিশ। তবে এরই মধ্যে শরীফ উদ্দিনকে দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরিচ্যুত করেছে।
এই চাকরিচ্যুতি দেশে বিস্ময় তৈরি করেছে এ কারণে যে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে দুদক সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করেনি। তবে শরীফ গত কয়েক বছরে বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতি চেষ্টার ঘটনায় তদন্ত করেছেন। বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি চাকরিজীবী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের নামে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। বহুজন আসামিও হয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় শরীফের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদিও দুদক সচিব মাহবুব হোসেনের দাবি, শরীফ কার কার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, এর সঙ্গে তার চাকরিচ্যুতির সম্পর্ক নেই। দুদক তার ভাবমূর্তি রক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা এবং ৭ থেকে ১০টি অভিযোগ রয়েছে।
তবে কী সেই সব অভিযোগ, সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব। তবে সংস্থাটির এই গোপনীয়তা কেন- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আইয়ুব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে শরীফ যে অভিযোগ এনেছেন, সেটা কতটা সত্য, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারা যায়নি বলে জানিয়েছেন খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা। তবে শরীফের বাসায় আইয়ুব গিয়েছেন- এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে সন্তোষ জানান, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে ঘটনার দিন শরীফের বাসার নিচে তার সঙ্গে কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক এমডি আইয়ুব খানকে কথা বলতে দেখেছেন তারা। তবে সেখানে হুমকি দেয়া হয়েছিল কি না, এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘দুদকের সাবেক কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়েছিলেন কি না সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে আমরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।‘
আইয়ুবের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান ওসি। বলেন, ‘কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক এমডি আইয়ুবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি জানান হুমকি নয়, মিডিয়ায় কোনো তথ্য না দিতে অনুরোধ করেছিলেন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা এই জিডির বিষয়ে দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়ে দেব। তার আগে শরীফ উদ্দিনকে ডাকা হবে। তার বক্তব্যও আমরা রেকর্ড করব।’
শরীফ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৩০ জানুয়ারি আমার বাসায় এসে আইয়ুব খান হত্যা ও চাকরি খেয়ে নেয়ার হুমকি দেয়ার পর জিডি করলেও এখনও সে বিষয়ে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ ১৫ দিন পর আমাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। এতে সহজেই অনুমেয়, প্রভাবশালী মহল কতটা পাওয়ারফুল। হুমকির পর আমি সেটা দুদকের কমিশনার ও আমার ডেপুটি ডিরেক্টর স্যারকেও জানিয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে আইয়ুবের বক্তব্য জানতে পারেনি নিউজবাংলা। তার ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জিডিতে যে অভিযোগ
গত ৩০ জানুয়ারি খুলশী থানায় করা জিডিতে শরীফ উদ্দিন উল্লেখ করেন, তিন দিনের ছুটিতে তিনি চট্টগ্রামের বাসায় আসার পর গত সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটের দিকে আইয়ুব খান চৌধুরী ও আরও একজন সহযোগী তার বাসার নিচে এসে দারোয়ানের সামনে হুমকি ও অশোভন আচরণ করেন।
সে সময় এক অতিথির সঙ্গে নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।
জিডিতে বলা হয়, আইয়ুব খান তাকে বলেন, শরীফের কারণে তার (এমডি) জীবন ধ্বংস হয়েছে। কীভাবে দুদকে চাকরি করেন, সেটি দেখে নেবেন।
শরীফের অভিযোগ, আইয়ুব খান চৌধুরী ফোনে আরও লোকবল ডেকে আনেন এবং হত্যার হুমকি দেন।
আইয়ুব কেন ‘ক্ষিপ্ত’
সরকারি ক্রয়নীতি উপেক্ষা করে ২০১৭ সালে ১১ কোটি টাকার জমি ১০৪ কোটি টাকায় কেনার অভিযোগ ছিল কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) বিরুদ্ধে। সে সময় কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন আইয়ুব খান চৌধুরী। তিনি বর্তমানে পেট্রোবাংলার পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক।
বাড়তি দামে জমি কেনার পেছনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। শরীফ উদ্দিনের তদন্তেও এ বিষয়টি উঠে আসে।
আবার কর্ণফুলী গ্যাসে আইয়ুব খান দুই ছেলে আশেক উল্লা চৌধুরী ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর পদোন্নতি নিশ্চিত করতে একজনকে চাকরিচ্যুত করা এবং অন্য নিয়োগ ঝুলিয়ে রাখা ও জনবল কাঠামো লঙ্ঘন করার প্রমাণ পায় দুদক।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলামের ছেলে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর ও নতুন সংযোগ দেয়ার ঘটনাও উঠে আসে শরীফ উদ্দিনের তদন্তে।
এই অভিযোগে ২০২১ সালের জুনে মামলা করেন শরীফ। এতে মোট পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন কেজিডিসিএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মজিবুর রহমান, সার্ভেয়ার দিদারুল আলম এবং অবৈধভাবে সংযোগ পাওয়া গ্রাহক মুজিবুর রহমান।
এই মামলায় মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক।
এতে কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক এমডি আইয়ুব খানের যোগসাজশও উঠে আসে দুদকের তদন্তে। তবে তার বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুর্নীতি দমন কমিশন।
এদিকে এসব বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলামের ছেলে মুজিবুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
শরীফের আলোচিত আরও কিছু তদন্ত
চাকরি থেকে অপসারণের আগ পর্যন্ত পটুয়াখালী দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপসহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন শরীফ উদ্দিন। তার আগে সাড়ে তিন বছর ছিলেন চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালে ২০২১ সালের ১৬ জুন ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ উদ্দিন।
একই বছর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে-সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই কার্যালয় তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে শরীফ উদ্দিনের তদন্তে।
কক্সবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলাও করেন তিনি। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে নামে দুদক। পরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও বেশ কয়েকটি মামলা করেছিলেন শরীফ উদ্দিন।