পিরোজপুরের কাউখালীর সোনকুড় গ্রামে সন্ধ্যা নদীর তীরে বিকেল হলেই ভেড়ে আব্দুল লতিফ খসরুর নৌকা। তাতে চড়ে বসে গ্রামের শিশুরা। সবাই মিলে গান-নাচ-গল্প করে। ফাঁকে ফাঁকে চলে লেখাপড়া।
বিনোদনের পাশাপাশি শিশুদের প্রাথমিক পাঠদানের এই কাজ খসরু করে আসছেন পাঁচ বছর ধরে। শিশুরা তাকে ডাকে খসরু দাদু বলে। আর এলাকায় তার উদ্যোগটি পরিচিত ‘খসরু দাদুর’ স্কুল নামে।
এই সোনকুড় গ্রামে কয়েক শ পরিবারের বাস। তাদের বেশির ভাগই জেলে, কুমার বা মাঝি। আশপাশে স্কুল না থাকায় এই গ্রামের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। দূরে পড়তে পাঠানোর খরচ বহনের সামর্থ্য নেই পরিবারগুলোর।
এই শিশুদের প্রাথমিক পাঠদানে নিজে থেকেই এগিয়ে আসেন কাউখালীর দক্ষিণ বাজারের ষাটোর্ধ্ব খসরু। একসময় কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবসরে যাওয়ার পর থেকে সময় কাটছিল না। তাই শখের বশেই তিনি নদীর তীরের ওই গ্রামের শিশুদের পড়ানোর কথা ভাবেন। একজন, দুইজনকে নিয়ে শুরুর পর এখন তার স্কুলে আসে প্রায় ৪০ শিশু।
খসরু নিউজবাংলাকে জানান, কাউখালীর খেয়াঘাট থেকে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে সপ্তাহে চার দিন তিনি ওই গ্রামে যান। বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৪টা-৫টা পর্যন্ত তিনি মেতে থাকেন শিশুদের নিয়ে। আবহাওয়া খারাপ দেখলে অবশ্য এই রুটিনে কিছু পরিবর্তন হয়।
নৌকায় আসতে শিশুদের আগ্রহী করতে চকলেট, বিস্কুটের মতো কিছু খাবারও দেন তিনি। বই-খাতাসহ আনুষঙ্গিক যা কিছু প্রয়োজন হয়, তিনিই সেসব কিনে আনেন।
পড়াশোনাকে মজার করতে গান-গল্প-কবিতার আসর বসান খসরু। শিশুরাও কিছু সময় আনন্দে মেতে ওঠে।
খসরু দাদুর স্কুলে নিয়মিত আসে ৫ বছরের লিমা। সে নিউজবাংলাকে বলে, ‘খসরু দাদু আমাদের পড়ালেখা করান। পড়া শেষে মজার মজার খাবার দেন। আমার এখানে পড়তে অনেক ভালো লাগে।’
আরেক ছাত্রী ৮ বছরের শারমিন আক্তার বলে, ‘প্রতিদিন আমরা সবাই দাদুর ট্রলারে আসি পড়তে। আমাদের এখানে কোনো স্কুল নেই, অনেক দূরে আছে। দাদু আমাদের পড়ার পাশাপাশি গান, কবিতা ও গল্পও বলেন। আমরা এখানে অনেক মজা করি।’
সন্তানকে খসরু দাদুর স্কুলে পাঠিয়ে সন্তুষ্ট মনজিলা বেগম।
তিনি বলেন, ‘নদীর তীরে আমরা অনেক পরিবার থাকি। এই এলাকার কাছে কোনো স্কুল নাই। তাই বাচ্চারা অনেক দূরে গিয়ে পড়তে চায় না। কাউখালীর খসরু ভাই প্রায় প্রতিদিনই আসেন। বাচ্চাদের পড়ান, খেলা করেন, পড়ালেখায় মনোযোগী করতে উৎসাহ দেন।
‘তা ছাড়া এলাকার যেকোনো পরিবারের সমস্যা হলে আমরা খসরু ভাইকে কাছে পাই। উনি বিপদের কথা শুনলে ছুটে আসেন।’
খসরু জানান, এই স্কুল চালাতে মাসে তার ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। ছোটখাটো কিছু ব্যবসা ও ছেলেদের দেয়া হাত খরচের টাকায় সেই খরচ চালান তিনি।
খসরু বলেন, ‘আমার এই উদ্যোগের লক্ষ্য শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানানো। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে এই শিশুদের মানসিক বিকাশে ও তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চালিয়ে যাব।’