রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে বস্ত্রকল বা স্পিনিং মিলগুলো এখন রমরমা ব্যবসা করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সুদিন এর আগে কখনই আসেনি এ খাতে। সাধারণত স্পিনিং মিল বা বস্ত্রকলগুলো ২ থেকে ৩ শতাংশ মুনাফা করলেও গত বছর ৬ থেকে ৭ শতাংশ হয়েছে। কোনো কোনো মিল ১০ শতাংশের বেশিও মুনাফা করেছে।
সে কারণেই করোনাভাইরাসের মধ্যে বস্ত্র খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। বেশ কয়েকটি স্পিনিং মিলসহ প্রায় ২০টি নতুন বস্ত্রকল স্থাপিত হচ্ছে দেশে। আবার ২৫-৩০টি পুরোনো বস্ত্রকল উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করছে। তাতে আনুমানিক ২৫০ কোটি ডলার বা ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে।
মূলত করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর থেকেই সুতার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্পিনিং মিলগুলোর ব্যবসা বাড়ছিল। সেই ধারা চলতি বছরও অব্যাহত রয়েছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করলে ২০২২ সালেও এ খাতের ব্যবসা ভালো যাবে বলে জানিয়েছেন স্পিনিং মিল মালিকরা।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই আমাদের খাতে সুদিন চলছে। পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। তার ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাদসংযোগ শিল্প হিসেবে আমরাও ভালো ব্যবসা করছি। এ ক্ষেত্রে আমরা আসলে ফুটবল মাঠে মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করি। পোশাক রপ্তানিকারকরা যে পোশাক রপ্তানি করেন (বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সদস্যরা) তার কাঁচামাল (সুতা-কাপড়) আমরা জোগান দিই।
‘বিষয়টি এভাবে ব্যাখা করা যেতে পারে: বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সদস্যরা হলেন মেসি-রোনাল্ডো। আর আমরা বিটিএমএর সদস্যরা হলাম মিডফিল্ডার। আমরা বল জোগান দিচ্ছি বলেই তারা গোল করতে পারছেন। আমরা যদি বল ঠিকঠাক মতো না দিই, তাহলে তারা গোল করতে পারবেন না। দেশেও বিদেশি মুদ্রা আসবে না। রিজার্ভ বাড়বে না।’
করোনাভাইরাসের মধ্যেই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগের পথে হাঁটছেন বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা। মহামারির কারণে ২০২০ সালের প্রথম দিকে বিনিয়োগ সেভাবে হয়নি। তখন কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করেন তারা। তবে ওই বছরের শেষ দিক থেকে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা আসতে থাকে।
বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুতা ও কাপড়ের চাহিদাও বাড়তে থাকে। তবে বিদেশি ক্রেতারা আগের চেয়ে কম লিডটাইম (ক্রয়াদেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) দেওয়ায় সেই চাপ এসে পড়েছে দেশীয় বস্ত্রকলের ওপর। বাড়তি এই চাহিদা আগামী দিনেও বজায় থাকবে। তাই নতুন কারখানার পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণে মনোযোগী হয়েছেন তারা।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রে জানা যায়, তাদের সদস্য হওয়ার জন্য ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ২০টি নতুন বস্ত্রকল আবেদন করেছে। কারখানাগুলো চলতি বছর থেকে শুরু করে আগামী দুই বছরে উৎপাদনে আসবে।
নতুন বিনিয়োগের ফলে আগামী দুই বছরে স্পিনিং খাতে ২০ লাখ স্পিন্ডল যোগ হবে। তা ছাড়া কাপড় উৎপাদনের নতুন মিলও আসবে।
প্রচুর বিনিয়োগের কারণ সম্পর্কে বিটিএমএর সভাপতি বলেন, ‘গত ২০ বছরে অনেকগুলো মিল ব্যবসা থেকে বেরিয়ে গেছে। অনেকে আবার আধুনিকায়ন করতে না পেরে পিছিয়ে গেছে। তা ছাড়া পাঁচ বছর পরপর বস্ত্রশিল্পে একটি সংস্কার হয়। সে জন্যই অনেক বিনিয়োগ আসছে। তাতে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে।’
মোহাম্মদ আলী খোকন দেশের অন্যতম বৃহৎ স্পিনিং মিল ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান। তিনি নিজেও ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩০ একর জমিতে দুই ধাপে ৮৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। তাতে ম্যাকসন্স গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান মেট্রো স্পিনিং, ম্যাকসন্স স্পিনিং এবং ম্যাকসন্স স্পিনিং (ইউনিট-২) গড়ে উঠবে। এসব কারখানায় ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় এমন সুতা, কাপড় ও রাসায়নিক উৎপাদন হবে।
ঢাকার ধামরাইয়ের কালামপুরে ৬৯৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে স্পিনিং মিল করছে করিম টেক্স লিমিটেড। ১ লাখ ১০ হাজার স্পিন্ডলের এই কারখানায় দিনে ৮০ টন সুতা উৎপাদিত হবে। চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ স্পিনিং মিলটি পুরোদমে উৎপাদনে যাবে। এর আগে জুলাই-আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে।
জানতে চাইলে করিম টেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ মিয়া বলেন, ‘করোনাকালে বিশ্বব্যাপী টি-শার্ট, ট্রাউজারের মতো নিট পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সে কারণে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্যই আমরা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ভিয়েলাটেক্স গ্রুপ তাদের স্পিনিং মিলের স্পিন্ডলের সংখ্যা ৪২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৩২ হাজারে উন্নীত করেছে।
ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কে এম রেজাউল হাসনাত বলেন, ‘করোনাকালে ক্রেতারা লিডটাইম কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে সুতা বা কাপড় আমদানি করে রপ্তানি করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ জাহাজ কবে আসবে, কেউ বলতে পারছেন না। দুই সপ্তাহ দেরি হলে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সে কারণে বস্ত্রকলগুলোয় ক্রয়াদেশ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ভবিষ্যতে বাড়তি এ ব্যবসা বজায় থাকবে ধরে নিয়ে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা।’
তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে বস্ত্রকলগুলো ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। তবে গত বছরের জানুয়ারি থেকে পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেছে। এই পরিমাণ ব্যবসা আগে কখনই আসেনি।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে একের পর এক ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হওয়ায় সুতা ও কাপড়ের রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। লকডাউনের কারণে পহেলা বৈশাখ ও ঈদের ব্যবসায় ধস নামে। অবশ্য দুই মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
বস্ত্রকল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের বস্ত্রকলের সুতার বড় প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে ভারত। আর কাপড়ে চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ। লকডাউনের কারণে বিদেশ থেকে সুতা ও কাপড় আমদানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেলে দেশীয় বস্ত্রকল সেই ব্যবসা পেয়েছে। তাই করোনার কঠিন সময়ের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানো তুলনামূলক সহজ হয়েছে।
বিটিএমএর সদস্যভুক্ত ৪৫০টি স্পিনিং, ৮৫০টি উইভিং এবং ১৭০টি ডাইং ও ফিনিশিং কারখানা রয়েছে। স্পিনিং মিল সুতা তৈরি করে। আর উইভিংয়ে সুতা থেকে কাপড়। বস্ত্র খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। তাতে নিট পোশাকের প্রয়োজনীয় সুতার ৮০-৮৫ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকের প্রয়োজনীয় কাপড়ের ৩৫-৪০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলো।
বস্ত্রকলগুলো যে ভালো ব্যবসা করছে তার প্রমাণ তাদের আর্থিক প্রতিবেদনেও পাওয়া যায়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মালেক স্পিনিং মিল গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার সুতা বিক্রি করেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তাদের সুতা বিক্রি ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ৯২ কোটি ১২ লাখ টাকার সুতা বিক্রি করেছে।
ম্যাকসন্স স্পিনিংয়ের বিক্রি বেড়েছে আরও বেশি, ৬২ শতাংশ। এই তিন মাসে ১৫৭ টাকার সুতা বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯৭ কোটি টাকা।
মতিন স্পিনিংয়ের বিক্রি ১০৬ কোটি থেকে বেড়ে ১৫৬ কোটি টাকা হয়েছে। স্কয়ার টেক্সটাইলের বিক্রি ২৬১ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮৩ কোটি টাকা।
বিটিএমএ সভাপতি ম্যাকসন্স স্পিনিংয়ের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বস্ত্র খাত খুব ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনা ধাক্কা কাটিয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে ভালো ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করে। এখনও সেটা অব্যাহত আছে। রপ্তানিমুখী বস্ত্রকলের গুদামে বর্তমানে সুতা ও কাপড়ের কোনো স্টক নেই।’
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে ২০২০ সালে প্রতিটি মিলেই বিপুল পরিমাণ সুতা অবিক্রীত ছিল। তখন গড়ে সুতার দাম ছিল ২ ডলার ৬০ সেন্ট। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ফলে গত বছরের অবিক্রীত সুতা গড়ে এক ডলার বাড়তি দামে বিক্রি করে স্পিনিং মিলগুলো। তাই অধিকাংশ মিল মুনাফা করেছে।’
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ‘সুতার ব্যবসায় মুনাফা অনেকাংশে তুলা কেনার ওপর নির্ভর করে। কম দামে তুলা কিনতে পারলেই বেশি মুনাফা হয়। তৈরি পোশাক খাতে ভালো ক্রয়াদেশ রয়েছে। সে কারণে সুতার চাহিদাও বেশি। বিশ্বব্যাপী ওমিক্রনে আক্রান্তদের মৃত্যুর খবর খুব একটা না থাকায় আশা করছি, চলতি বছরও ভালো ব্যবসা হবে।’
তবে চলমান কোভিড মহামারি পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বস্ত্র খাতের পাশাপাশি পোশাক রপ্তানিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম ৩৬২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। বর্তমানে এক কেজি সুতা উৎপাদনে বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে ২০ টাকা। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে এক কেজি সুতা উৎপাদনে বিদ্যুৎ ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
‘অথচ এমনিতে বিশ্ববাজারে তুলার অস্থিতিশীল মূল্যের কারণে চাপে রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। কারণ তুলা-সুতার দর যে হারে বেড়েছে, সে হারে মূল্য দিচ্ছে না বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো। এ অবস্থায় গ্যাসের দর বাড়ানো হলে বস্ত্র ও পোশাক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
গ্যাসের দাম আবারও বাড়ানো হলে দেশে বৈধ ও অবৈধভাবে আসা সুতা ও কাপড়ের সঙ্গে দর প্রতিযোগিতায় টেকা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
জানুয়ারির শুরুতে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করে জ্বালানি বিভাগ। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এখনও সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।