যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্র কেনাকাটায় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু যার নামে অভিযোগ, সাবেক সেই উপপরিচালক এ-সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ ভুলে গেছেন বলে দাবি করেছেন।
দেড় বছর আগের ওই কেনাকাটায় যশোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরকে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা দিয়েছিল মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামমাত্র মূল্যে আসবাবগুলো কিনে প্রায় পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছেন যশোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক সোখিনা বেগম।
সরকারি বরাদ্দের টাকায় মালামাল ক্রয়ের জন্য কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের একটি ক্রয় কমিটি আছে। কিন্তু এই কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে কোটেশনের মাধ্যমে নিজেই আসবাবপত্রগুলো কিনেছিলেন সাবেক উপপরিচালক।
দেখা গেছে, দেড় বছর আগে সাবেক উপপরিচালক সোখিনা বেগম ২০টি সিঙ্গেল তোশকের ক্রয়মূল্য দেখান ৬৬ হাজার টাকা। সেই অনুযায়ী, প্রতিটি তোশকের মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এ ধরনের একেকটি তোশকের মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে।
এ ছাড়া ২৬টি সিঙ্গেল খাট ক্রয়ে মূল্য দেখানো হয় ৩ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। এ হিসাবে একেকটি খাটের মূল্য দাঁড়ায় ১২ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ স্থানীয় বাজারে এ ধরনের খাট দেড় থেকে ২ হাজারেই পাওয়া যায়।
দুটি ছোট স্টিলের আলমারির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে এই আলমারি দুটির দাম ১৪ হাজারের বেশি নয়। চার ড্রয়ারের একটি ছোট স্টিল ফাইল কেবিনেটের দাম দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৯৫০ টাকা। যশোরের বাজারে এটির দাম সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা।
২ লাখ ৪ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে ১২টি ড্রেসিং টেবিল। অর্থাৎ প্রতিটির ক্রয়মূল্য পড়েছে ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে এ ধরনের ড্রেসিং টেবিল ৩-৪ হাজারের মধ্যে দেদার বিক্রি হচ্ছে।
১০-১২ হাজারে পাওয়া যায় এমন দুটি ডাইনিং টেবিলের মূল্য দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। আর ১২-১৫ হাজারে পাওয়া যায় এমন একটি সোফা সেটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা।
উল্লিখিত ৬৪টি পণ্যের মূল্য দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২৫০ টাকা। এর সঙ্গে ৭ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করে মূল্য দেখানো হয় ৮ লাখ ২৪ হাজার ১৬৭ টাকা।
অন্য একটি ভাউচারে একটি ৫৬ সিএফটি সার্ফ ডিপ ফ্রিজের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ টাকা। বাজারে এটি ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
একটি ফটোকপি মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে দেড় লাখ টাকা; যার প্রকৃত মূল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া অখ্যাত ব্র্যান্ডের চায়না ৫৬ ইঞ্চি টেলিভিশনের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। বাজার এটি ১৫ থেকে ১৮ হাজারেই পাওয়া যায়।
একটি ডেক্সটপ কম্পিউটারের মূল্য দেখানো হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু এর মধ্যে সন্নিবেশ করা যন্ত্রাংশগুলোর যাচাই করে দেখা যায়, এটি ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকার মধ্যেই। ক্যাননের একটি প্রিন্টারের দাম ২৫ হাজার টাকা ধরা হলেও এর বাজারমূল্য ১০-১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া একটি স্ক্যানার মেশিনের মূল্য ১০ হাজার টাকা ধরা হলেও এর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই ঘটনা ঘটেছে ১৫ হাজার টাকা মূল্য দেখানো একটি ফ্যাক্স মেশিনের ক্ষেত্রেও।
সম্মিলিতভাবে ওই সাতটি পণ্যের মোট দাম ধরা হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা, যা বর্তমান বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি।
এ ছাড়া অবশিষ্ট ৪ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৩ টাকায় ক্রয় দেখানো হয়েছে ১২টি স্টিলের আলনা, একটি কম্পিউটার টেবিল, একটি চেয়ার, হাতলযুক্ত ১০টি গদিওয়ালা চেয়ার, দুটি জুনিয়র এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি মিটসেফ, হাতলযুক্ত কাঠের চেয়ার তিনটি, রিডিং টেবিল ৩৬টি ও ২৬টি সাধারণ চেয়ার।
কেনাকাটার বিষয়ে হোস্টেলের অফিস সহকারী নাসরিন আক্তার মালা বলেন, ‘আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য একটি কমিটি থাকলেও সখিনা বেগম কমিটির কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে নিজের ইচ্ছামতো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল ভাউচার করে মালামালগুলো সরবরাহ করেছেন। মালামালগুলো গ্রহণ করা হয়েছে এই মর্মে হোস্টেল সুপারের কাছ থেকে অনেকটা জোর করেই লিখিত নিয়েছেন তিনি।’
এ বিষয়ে যশোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক সোখিনা বেগমের মোবাইলে কল করলে তিনি প্রতিবারই ব্যস্ততার অজুহাতে কথা না বলেই লাইন কেটে দিয়েছেন।
যশোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের বর্তমান উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি দুই মাস হলো। আসার পর পরই বিষয়টি জেনেছি। পরে সাবেক উপপরিচালককে লিখিতভাবে বিষয়টি জানালে তিনিও লিখিতভাবে জানান, বেশ কিছুদিন হয়ে যাওয়ায় এ-সংক্রান্ত অনেক বিষয় তিনি ভুলে গেছেন।’
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হবে বলেও জানান আনিসুর রহমান।
বিষয়টি নিয়ে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনোয়ারা ইশরাত বলেন, ‘যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল কেনাকাটার জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল দেড় বছর আগে। সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে বিল ভাউচার দাখিল করেছেন। কিন্তু কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
অবগত হওয়ায় এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে বলে জানান যুগ্ম সচিব। টাকা আত্মসাৎ করে থাকলে সাবেক উপপরিচালকের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, শুধু এসবই নয়, যশোর মহিলা অধিদপ্তরের দায়িত্ব থাকাকালীন মন্ত্রণালয়ের আরও বেশ কিছু বরাদ্দের অর্থ নয়ছয় করেছেন সোখিনা বেগম।