গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে একের পর এক জেব্রার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য অভিযোগ তুললেন, এই প্রাণীগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এই ঘটনায় আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এমনও জানিয়েছেন, পার্কটিতে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে, যে তথ্য কর্তৃপক্ষ গোপন করেছে।
গত এক মাসে সেখানে ১১টি জেব্রার মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড়ের মধ্যে রোববার পার্কটিতে যায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের করা কমিটি। তাদের সঙ্গে ছিলেন গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন।
পরিদর্শন শেষে সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের জানান, তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, পার্কে ওই ১১টি জেব্রাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘১১ জেব্রার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। জেব্রাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একে অপরকে ফাঁসানোর জন্য এই জেব্রাগুলো হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমি মামলা করব।
‘গত মাসে সাফারি পার্কে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এটা কেউ জানে না। এত মূল্যবান প্রাণী মারা যাচ্ছে, অথচ পার্ক কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে যাচ্ছে। পার্কে ১০টি বাঘ ছিল, একটি পুরুষ বাঘ মারা যাওয়ায় এখন মোট বাঘের সংখ্যা ৯টি।’
বাঘ মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকারও করেছেন পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান। তার দাবি, ওই বাঘটি বেষ্টনীতে পায়ে আঘাত পেয়েছিল। এরপর এটি দুই মাস অসুস্থ ছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা করেছেন।
সাফারি পার্ক পরিদর্শন শেষে কথা বলছেন গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক চিকিৎসক রফিকুল আলম অসুস্থ বাঘটির সার্জারি করেছিলেন। দেড়-দুই মাস পর অসুস্থ বাঘটি খাবার কমিয়ে দেয়। এরপর গত ১২ জানুয়ারি মারা যায়।
‘মৃত্যুর পর বাঘের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের একটি প্রতিবেদন এসেছে। তবে সেই প্রতিবেদনটি খারাপ রিপোর্ট হওয়ায় প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টটি প্রকাশ হলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। যে কারণে কনফার্ম না হয়ে বলা যাচ্ছে না।’
‘গত মাসে সাফারি পার্কে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এটা কেউ জানে না। এত মূল্যবান প্রাণী মারা যাচ্ছে, অথচ পার্ক কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে যাচ্ছে। পার্কে ১০টি বাঘ ছিল, একটি পুরুষ বাঘ মারা যাওয়ায় এখন মোট বাঘের সংখ্যা ৯টি।’
আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কী আছে রিপোর্টে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রিপোর্টে যে ধরনের জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে তা এই এলাকায় সাধারণত দেখা যায় না। জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ প্রতিবেদনটি প্রত্যাহার করেছেন।
‘আমরা কনফার্ম হওয়ার জন্য ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনটি পুনরায় করার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি। বাঘের মৃত্যুর বিষয়টি এ কারণেই প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানায় একটি সিংহের মৃত্যুর সময় একই রিপোর্ট এসেছিল। এটা এলার্মিং, সবার জন্য এলার্মিং এটা।’
জেব্রাগুলোকে হত্যার অভিযোগ তদন্তে সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের বদলি করা জরুরি বলেও মনে করেন সংসদ সদস্য ইকবাল।
তিনি তদন্ত কমিটির সদস্যদের বলেন, ‘যাদের তত্ত্বাবধানে জেব্রা মারা গেছে তাদের স্বপদে বহাল রেখে সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব নয়। এতে পার্কের অন্য কর্মচারীরা মুখ খুলতে সাহস পাবে না। পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমানকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তারপর তদন্ত করতে হবে।’
এমপি ইকবালের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সীমানাপ্রাচীরের ভেতর থেকে হাতির খাবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি তিনি।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। কর্মকর্তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটি প্রশাসনের বিষয়।’
পার্কে গত ২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ১১ জেব্রার মৃত্যু হয়।
পার্ক কর্তৃপক্ষ যা জানায়
পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবির জানান, ১১টির মধ্যে সবশেষ শনিবার সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে মারা যায় দুটি।
তিনি জানান, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চারটি জেব্রা মারা গেছে। আর বাকিগুলোর মৃত্যু হয়েছে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে।
৯টি জেব্রারই মৃত্যু হয়েছে গত ২ থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে। নেতিবাচক পরিস্থিতির কথা ভেবেই তাৎক্ষণিকভাবে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তবে মৃত্যুর পর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সবগুলো জেব্রার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
পরে তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা ঢাকার মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার ও ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়।
সোমবার রাতে সেসবের রিপোর্ট এসেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে জেব্রাগুলোর মৃত্যুজনিত কারণে বিশেষজ্ঞ দল পার্ক পরিদর্শন করেন। দুপুরে তারা পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
এ সময় মৃত জেব্রাগুলোর সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা. এ বি এম শহীদ উল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নুর আলী খান, ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম, ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম উকিল উদ্দিন ও সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. হাতেম সাজ্জাত জুলকারনাইন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের অধ্যাপক রফিকুল আলম বলেন, ‘এসব প্রাণীর মৃতদেহে পাঁচ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’
বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রফেসর আবু হাদী নুর আলম খান ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে বলেন, ‘একই ঘাস সব ধরনের তৃণভোজী প্রাণী খাচ্ছে। অন্য কোনো প্রাণীর সমস্যা হচ্ছে না, শুধু জেব্রারই হচ্ছে। এ জন্য আপাতত অবজারভেশনের জন্য এক সপ্তাহ বা দশ দিন ঘাস পরিবর্তন করে অন্য জায়গার ঘাস দেয়া হবে। সব প্রাণীর পাকস্থলীর ক্ষমতা বা হজমক্রিয়া এক রকম না।’
তিনি জানান, অন্যান্য প্রাণীকে যথারীতি আগের খাবারই দেয়া হবে। তবে সতর্কতা হিসেবে সেই খাবারগুলো প্রথমে ধুয়ে তারপর চপিং মেশিনে দিয়ে ছোট ছোট করে কেটে শুকিয়ে তারপর সরবরাহ করা হবে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘মানিকগঞ্জ থেকে ঘাস এনে জেব্রার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। সেখানকার ঘাস পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাই বর্তমানে অবশিষ্ট যে প্রাণীগুলো সাফারি পার্কে আছে তাদের সুস্থতায় বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি বাকি প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারব।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাকি প্রাণীগুলোকেও নজরদারি করা হচ্ছে। তাদেরকে খাবারের সঙ্গে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন মলসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।’
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ করে এভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যু খুবই কষ্টকর। নিজের হাতে লালন পালনের পর চোখের সামনেই এদের মৃত্যু দেখতে হলো। অসুস্থ হওয়ার মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যেই মারা গেছে জেব্রাগুলো। এখানে আমাদের কারও কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল না।