বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হোসেনের বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ‘বিকৃতি’

  •    
  • ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ১৯:২০

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’য় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন-এমন অভিযোগ উঠেছে। আরো অভিযোগ- তিনি রাজাকার ক্যাম্পে বীর মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতন ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেনের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত তার আত্মজীবনী গ্রন্থে ‘বিকৃত’ ইতিহাস তুলে ধরা নিয়ে ক্ষুব্ধ যশোরের মুক্তিযোদ্ধারা।

হোসেনউদ্দীন হোসেন তার যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা নিয়ে ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’ নামে একটি বই লিখেছেন। ২০১২ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই চলছে এই ক্ষোভ।

বইটিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হামিদকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হোসেনউদ্দীন হোসেন নিজেকে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করলেও সপক্ষে প্রমাণ মেলেনি। অভিযোগ আছে রাজাকারের পক্ষ হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতনেরও।

বইয়ের ২৩৪ পৃষ্ঠায় হোসেনউদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘কয়েকদিন পরে হানাদার বাহিনী কায়েমখোলা গিয়ে একটা হামলা চালালো।.... পথিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা গোপন সংবাদ পেয়ে হানাদার বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। হামিদ নামক একজন রাজাকার এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। সিদ্দিক নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক জখম হন। হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। কয়েকদিন পর যুদ্ধে নিহত রাজাকার হামিদের নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়।’

কে এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ

ঝিকরগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের বিবরণ অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর ১৯৭১ কায়েমখোলায় (পরে গ্রামটি ভেঙে ছোট কুলি নামে আরেকটি গ্রাম হয়েছে) নিহত হন আব্দুল হামিদ। তিনি ছিলেন ঝিকরগাছা উপজেলা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) সেকেন্ড ইন কমান্ড ও ডেপুটি কমান্ডার।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওইদিন সকালে পাকিস্তানি বাহিনী আমচকা অভিযানে গিয়ে বিলের ব্রিজের উপরে আব্দুল হামিদকে পেয়ে যায়। সঙ্গে থাকা গ্রেনেড ছুড়লেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিস্ফোরিত না হলে ব্রিজ থেকে বিলে লাফ দেন তিনি। কিন্তু বিলে কচুরিপানায় সাঁতার কাটতে না পারায় হানাদাররা তাকে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। আর তার কমান্ডে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিককে হানাদাররা ধরে নিয়ে যায়।

বইয়ের এই অংশ নিয়ে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা কমিটি হোসেনউদ্দীন হোসেনের কাছে জানতে চায় তিনি কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদকে রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জবাবে হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, এই হামিদ যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা হামিদ নয়।

যুদ্ধের পর বর্তমান রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ আব্দুল হামিদের নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়। যশোরের কুলি-কায়েমখোলা সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের নামে করা হয়েছে। বাঁকড়া-শিমুলিয়া সড়কেরও নামকরণ করা হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হামিদের সঙ্গে। ঝিকরগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলকে ১ নম্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের নাম লেখা। এছাড়া ১৯৭২ সালে সরকারি সব তালিকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার রয়েছে।

বইয়ের এই অংশ নিয়ে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা কমিটি হোসেনউদ্দীন হোসেনের কাছে জানতে চায় তিনি কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদকে রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

জবাবে হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, এই হামিদ যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা হামিদ নয়।

অথচ যাচাই-বাছাই কমিটিকে আহত মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিক জানান, রাজাকার হামিদ বলে সেদিন কেউ ছিল না। ওইদিন যিনি নিহত হন তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হামিদ।

এ ঘটনার পর কমিটি হোসেনউদ্দীন হোসেনের কাছে জানতে চায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন কী প্রমাণ আছে এবং মুক্তাঞ্চলে কোন ক্যাম্পের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন। হোসেনউদ্দীন হোসেন ওই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি।

এ ঘটনার পর কমিটি হোসেনউদ্দীন হোসেনের কাছে জানতে চায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন কী প্রমাণ আছে এবং মুক্তাঞ্চলে কোন ক্যাম্পের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন। হোসেনউদ্দীন হোসেন ওই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি (২০১৭ সালের সেই শুনানির ভিডিও নিউজবাংলার কাছে আছে)।

ইতিহাসের ভুল তথ্য দেয়ার অভিযোগ এনে হোসেনউদ্দীন হোসেনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের সুপারিশ করে বাছাই কমিটি।

পরে ঝিকরগাছার তৎকালীন ইউএনও আব্দুল জলিলসহ কমিটির সব সদস্যের স্বাক্ষর করা এক প্রতিবেদনে হোসেনউদ্দীন হোসেনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তার ভাতা বন্ধ করে দেয় সরকার।

২০২০ সালে আরাফাত হোসেন ইউএনও থাকার সময় হাইকোর্টের একটি রিটের বিপরীতে তাঁর কাছে তথ্য চাওয়া হলে সেখানেও হোসেনউদ্দীন হোসেনের এই ‘বিতর্কিত’ তথ্যগুলো তিনি নথিভুক্ত করে প্রতিবেদন পাঠান।

নিউজবাংলার পক্ষ থেকে শহীদ হামিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, ‘আমি যে হামিদের কথা বলেছি তিনি সেই হামিদ নন। তবে হামিদ যুদ্ধে অংশ নেননি, এমনকি মুজিব বাহিনীরও কেউ যুদ্ধে অংশ নেয়নি।’

রাজাকার হামিদের গ্রাম কোনটি- এমন প্রশ্নেরও উত্তর দেননি তিনি।

রাজাকার কমান্ডারের প্রশংসা

মুক্তিবাহিনী ৬ ডিসেম্বর ঝিকরগাছা শত্রুমুক্ত করে। তখন মুক্তিযুদ্ধকালে লুটপাট, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে ঝিকরগাছা থানা আনসার কমান্ডার সিদ্দিককে হত্যা করে।

হোসেনউদ্দীন হোসেন তার বইয়ের ১৬৩-১৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- অন্য রাজাকাররা যখন আমাকে ডেকে নিয়ে যায় তখন আনসার কমান্ডার সিদ্দিক আমাকে চা-নাস্তা খেতে দেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসার সম্মানের সঙ্গে কথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।

তিন পৃষ্ঠা জুড়ে ওই সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখে এই রাজাকার কমান্ডার সিদ্দিকের প্রশংসা করেছেন হোসেনউদ্দীন হোসেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পায়নি কমিটি

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে গঠিত ঝিকরগাছা উপজেলা কমিটি হোসেনউদ্দীন হোসেনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে জীবিত কোনো মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষ্য পায়নি। তার পক্ষে একমাত্র সাক্ষ্য দিতে আসেন ভাগ্নি জামাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের। কাদেরের সঙ্গে কোথায় যুদ্ধ করেছেন জানতে চাইলে উত্তর না দিয়েই কমিটির শুনানি থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

যা বললেন হোসেনউদ্দীন হোসেন

এসব অভিযোগের বিষয়ে হোসেনউদ্দীন হোসেনের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পুরো কথোপকথনে সহযোদ্ধা হিসেবে আব্দুল কাদের ছাড়া আর কোনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে পারেননি তিনি। আব্দুল কাদেরের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল নম্বর চাইলেও তিনি দিতে রাজি হননি।

একাত্তরে একটিমাত্র যুদ্ধের কথা বলেছেন তিনি, সেটি হচ্ছে ১০ জুলাইয়ের লাউজানি যুদ্ধ।

কিন্তু সীমান্তবর্তী হওয়া সত্ত্বেও ওই যুদ্ধের খবর জীবিত কোনো মুক্তিযোদ্ধা যেমন জানেন না, তেমনি কলকাতা ও বঁনগা থেকে প্রকাশিত কোনো পত্রিকায় এই যুদ্ধের বিবরণ নেই। এমনকি লাউজানির বয়োবৃদ্ধরাও এখানে ওই তারিখে যুদ্ধ হওয়ার কথা জানেন না।

ঝিকরগাছা থানার দুই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রশিদ ও লিয়াকত আলী বলেন, ‘এরকম কোনো যুদ্ধ হয়নি। একাত্তরে আমরা এ অঞ্চলে সার্বক্ষণিক সক্রিয় থেকেছি। এমন যুদ্ধ হলে আমাদের জানার কথা।’

মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতনের অভিযোগ

ঝিকরগাছার নাভারণ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা হাশেম অভিযোগ করেছেন, তাকে যখন রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যায় তখন নির্যাতকদের মধ্যে হোসেনউদ্দীন হোসেনও ছিলেন।

যশোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘রাজাকাররা আমাকে যখন নাভারন ক্যাম্পে নিয়ে যায় তখন হোসেন সেখানে ছিল।’

মুক্তিযোদ্ধা হাশেমের গ্রুপ কমান্ডার লিয়াকত আলী বলেন, “হোসেনউদ্দীন ১৯৬৫ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেন তখন থেকেই ঝিকরগাছার মানুষ তাকে চেনে। মুক্তিযোদ্ধা হাশেম আমাকে বলেছিল- আমাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন সেখানে হোসেন ভাই ছিল।”

এ প্রসঙ্গে হোসেনউদ্দীন হোসেন বলেন, ‘রাজাকার হোসেন নামে আরেকজন ছিল, আমি না। আমি নাভারণে যাইনি।’

অথচ নিজের ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’ বইয়ে তিনি একাধিকবার নাভারন যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

বিষয়টির উল্লেখ করে স্ববিরোধী বক্তব্য দেয়ার কারণ জানতে চাইলে হোসেনউদ্দীন রেগে যান। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন- ‘আপনার সব সাক্ষ্যদাতাকে আমার সামনে আনেন।’

এ বিভাগের আরো খবর