তিন বছর মেয়াদি নতুন আমদানিনীতি আদেশ চূড়ান্ত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে এই নতুন নীতি আদেশে ব্যবসায়ীদের জন্য থাকছে হরেক সুবিধা। এতে আমদানি সহজ করার মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে।
গত এক যুগে দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয় শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। বড় হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে নতুন আমদানিনীতি আদেশে স্থানীয় শিল্পের প্রসারে পদক্ষেপের পাশাপাশি আমদানির সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে কিছু কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে।
এভাবেই বৈশ্বিক অঙ্গনের সঙ্গে আগামী তিন বছর দেশের আমদানি বাণিজ্য কোন মানদণ্ডে পরিচালিত হবে, তার রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর প্রস্তাবিত নাম রাখা হয়েছে ‘আমদানিনীতি আদেশ ২০২১-২৪।’
নতুন আমদানিনীতি আদেশটি রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়া হবে। সোমবারই বসছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কার্যতালিকায় প্রস্তাবিত ‘আমদানিনীতি আদেশ ২০২১-২৪’ অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্থান পাচ্ছে। নতুন করে জটিলতা তৈরি না হলে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চলতি সপ্তাহ অথবা আগামী সপ্তাহের বৈঠকে নতুন আমদানিনীতি আদেশটি অনুমোদন পেতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নীতি আদেশটি প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অংশীজনদের মতামত। গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে এ কাজটি করে আসছে মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি আমদানিনীতির একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয় এই নতুন নীতি আদেশটির ওপর আইনি পরীক্ষা কার্যক্রমও (ভেটিং) শেষ করেছে।
প্রতি তিন বছর পর পর দেশে একটি নতুন আমদানিনীতি আদেশ জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ২০১৮-২০২১ সালে আমদানিনীতি জারি করা হয়নি। সবশেষ ‘আমদানিনীতি আদেশ ২০১৫-১৮’ এখন পর্যন্ত আমদানির ক্ষেত্রে বলবৎ আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, নতুন আমদানিনীতি আদেশ ২০২১-২৪ চূড়ান্ত। রোববার তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। চলতি সপ্তাহে সম্ভব না হলে আগামী সপ্তায় আমদানিনীতি আদেশটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উঠতে পারে। সেখানে অনুমতি মিললে খসড়াটি গেজেট আকারে জারি করা হবে।
কী থাকছে নতুন আমদানিনীতি আদেশে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নয়নে আমদানিকে সহজ করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ রাখা হয়েছে এই আমদানিনীতি আদেশে। এতে ব্যবসায়ীরা উদ্বুদ্ধ হবেন এবং উপকৃত হবেন। স্থানীয় শিল্পেরও প্রসার ঘটবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নতুন আমদানিনীতি আদেশ অনুযায়ী দেশে পুরোনো মোটরসাইকেল আমদানি নিষিদ্ধ হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো আমদানিকারক ব্লুটুথ অ্যানাবেল টেকনোলজিসংবলিত মোটরসাইকেল আমদানি করতে চাইলে তাকে আগে থেকেই বিটিআরসির অনুমতি নিতে হবে। থাকতে হবে অনুমোদিত সার্টিফেকেটও। নিষিদ্ধ হচ্ছে ক্যাসিনো বা জুয়াখেলার পণ্যসামগ্রী আমদানিও।
নতুন আমদানিনীতি অনুযায়ী কোনো আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক জাল, ঘষামাজা, মিথ্যা কাগজপত্র দাখিল করে জালিয়াতির মাধ্যমে নিবন্ধন সনদ গ্রহণ, গ্রহণের উদ্যোগ বা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন করলে আমদানিনীতি আদেশের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমদানি-রপ্তানিকারককে কালো তালিকাভুক্তি, তার সনদ স্থগিত বা বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে এক্সপোর্টস কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৫০ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষায় সংকুচিত করা হচ্ছে পুরাতন কাপড় আমদানির পথও। তাই নতুন আমদানিনীতিতে সংশ্লিষ্ট ধারায় সংশোধনী এনে পুরাতন কাপড় আমদানির পথ সংকুচিত করা হচ্ছে, যা ২০২৬ সালের পর শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ পরবর্তী আমদানিনীতি আদেশ ২০২৪-২৭ স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে পুরাতন কাপড় আমদানি।
এ ছাড়া বিদ্যমান আমদানিনীতি অনুযায়ী বর্তমানে দেশের তারকামানের হোটেলগুলোরই শুধু অ্যালকোহল ও অ্যালকোহলিক বেভারেজ আমদানির অনুমতি রয়েছে। বাকিদের ক্ষেত্রে রয়েছে অস্পষ্টতা।
তবে এবার পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে শুধু সরকার অনুমোদিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত রেস্তোরাঁ, বার, সামাজিক ক্লাব, প্রাইভেট ক্লাব, চিত্তবিনোদন ক্লাবগুলোকেও তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যালকোহল ও অ্যালকোহলিক বেভারেজ আমদানির অস্পষ্ট নির্দেশনাকে স্পষ্ট করার প্রস্তাব রয়েছে। এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সবুজসংকেত পেলে সংশ্লিষ্ট ধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
থাকছে যেসব সুবিধা
নতুন আমদানিনীতিতে বিদ্যমান নীতিমালার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযোজন-বিয়োজন বা সংশোধন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং ইনডেন্টরদের নিবন্ধন ফি ও নবায়ন ফি হ্রাস করা হয়েছে।
প্রচলিত আমদানি নীতিমালায় একজন আমদানিকারককে প্রতিবছর আমদানি নিবন্ধন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হয়। তবে নতুন নীতিমালায় এখন থেকে প্রতি বছর নয়, বরং পাঁচ বছর পর একবার নবায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন ফি কমানো হয়েছে।
এ ছাড়া এলসির পাশাপাশি ক্রেতা-বিক্রেতা চুক্তির মাধ্যমে আমদানিকারক পণ্য আমদানি করতে পারবেন। ফলে যে কেউ সহজেই বিদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানির সুযোগ নিতে পারবেন। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতের ব্যবসায়ীদের নমুনা আমদানি সহজ করা হয়েছে।
বর্তমান আমদানিনীতিতে সংশ্লিষ্ট আমদানি-রপ্তানি দপ্তরাধীন এলাকার মধ্যেই শুধু ঋণপত্রের মনোনীত ব্যাংক পরিবর্তনের সুযোগ আছে। তবে নতুন আমদানি নীতিতে আমদানিকারকের জন্য তার ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো ব্যাংক পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
বর্তমান নিয়মে আমদানি ঋণপত্র খোলার পর ঋণপত্রের কপি ১৫ দিনের মধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। নতুন নিয়মে ডিজিটাল মাধ্যমে জমা দিলেই চলবে।
এ ছাড়া বর্তমানে আমদানির জন্য প্রাথমিক সনদের সর্বনিম্ন নিবন্ধন ফি ৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা ধার্য রয়েছে। বার্ষিক নবায়ন ফি দিতে হয় ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা।
নতুন আমদানিনীতিতে সর্বনিম্ন প্রাথমিক নিবন্ধন ফি কমিয়ে ৩ হাজার টাকা, বার্ষিক নবায়ন ফি ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বছর বছর নবায়নের ঝামেলা যাতে না পোহাতে হয় সে লক্ষ্যে পাঁচ বছরের জন্য নবায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে আমদানিনীতিতে। এ জন্য সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিবন্ধন ফি প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রচলিত নীতিতে আমদানিকারকদের বার্ষিক আমদানির পরিমাণ ৫ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে পর্যন্ত মোট ছয়টি শ্রেণিতে নিবন্ধন সনদের সুযোগ ছিল। এটি সহজ করার জন্য নতুন নীতিতে পাঁচটি শ্রেণিতে নিবন্ধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বার্ষিক আমদানিসীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ১০ লাখ থেকে তার ওপরে ৫০ লাখ, ১ কোটি, ৫ কোটি ও ৫ কোটির ওপরে এ পাঁচটি ভাগে নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে।