সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার কিছুটা স্বস্তির খোঁজে রাজধানীর হাতিরঝিলের বিভিন্ন স্থানে ভিড় জমায় কয়েক হাজার মানুষ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই ছিলেন উদাসীন। বিধিনিষেধ, সামাজিক দূরত্ব তো মানেননি, তাদের মুখে ছিল না মাস্কও। কজনের মুখে মাস্ক থাকলেও তা ছিল না থাকার মতোই। কেউ গলায়, কেউ থুতনিতে, আবার কেউ পরেছেন নাকের নিচে।
হাতিরঝিলে দিনভর মানুষের এমন উপস্থিতি দেখে আঁচ করা যায় না দেশে করোনার নতুন ধরন কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে।
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে দেশে নতুন করে বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সমাবেশ এবং জনসমাগমে নিষেধ রয়েছে।
বিধিনিষেধের দ্বিতীয় দিনেই দেশে করোনায় সাড়ে চার হাজার সংক্রমণের খবর হাওয়া গেছে। আর আগের ৪৮ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৮ জন। তার পরও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা ছিল না বললেই চলে।
বিকেলে পুলিশ প্লাজা পেরিয়ে হাতিরঝিলের হাতির ভাস্কর্যের সামনে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে আসেন বাবা মোশাররফ হোসেন। বাবা-ছেলে কারও মুখেই মাস্ক নেই। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে ছেলে আসিফ, এর-ওর গায়ে বাড়ি খাচ্ছে। আর তার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছেন বাবা।
মোশাররফ বলেন, ‘ছেলে জিদ ধেরেছে বাইরে যাবে। তাছাড়া ঘরে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে। এ জন্য তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি। ছেলে মাস্ক মুখে রাখে না। আমিও মাস্ক মুখে নিয়ে ওর সঙ্গে দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠি। শুক্রবার ছাড়া অন্য দিন তো সময় হয় না।’
করোনার এ সংক্রমণের মুহূর্তে ছেলেকে নিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা, কপালে থাকলে ঘরে থেকেও হবে, না থাকলে হবে না।’
হাতিরঝিলের বিভিন্ন অংশে কয়েক হাজার মানুষের জটলা হলেও সবচেয়ে বড় জলটা থাকে পুলিশ প্লাজার পেছনে হাতির ভাস্কর্য ঘিরে। এ ছাড়া বিভিন্ন সেতুর ওপর এবং এর আশপাশেও আড্ডায় মাতে মানুষজন।
হাতির ভাস্কর্যের আশপাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও প্রায় হাজার মানুষের জটলা। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ পরিবার নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আবার একান্তে বসে আলাপ করছেন প্রেমিক যুগল, কিংবা বন্ধুদের আড্ডাও চলছে কোথাও।
এখানে বিধিনিষেধের মধ্যেও ছোটখাটো পিকনিকের আয়োজন করেছে ঢাকার গুলশান-বনানীতে কাজ করা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের একটি সংগঠন। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার পর বিকেলে র্যাফেল ড্রয়ের আয়োজনও করেছেন তারা। আর কয়েক শ মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে তাদের কার্যক্রম দেখছিল।
জানতে চাইলে আয়োজকদের একজন মো. রাসেল বলেন, ‘ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা বাতিল করে আমরা হাতিরঝিলে একত্র হয়েছি। আমাদের দেখে মানুষ একত্র হয়েছে, তাদের সরিয়ে দিতেও পারছি না।’
বন্ধুদের সঙ্গে পুরান ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা রিয়াজ বলেন, ‘সারা সপ্তাহ তো কাজ থাকে। তাই শুক্রবার একটু বিনোদন ও মনের আনন্দের জন্য এখানে ঘুরতে এসেছি। ছুটির দিনে গাড়ি কম থাকে, মনের আনন্দে বাইকও চালানো যায়।’
মানুষের ভিড়ের কারণে হাজির হয়েছেন বেলুন, ঝালমুড়ি, পিঠা, সিগারেট বিক্রেতাসহ ডজনখানেক হকার। বেলুন বিক্রেতা রুবেল বলেন, ‘আমাগো একদিন না বাইর অইলেও ঘরের চাইল কিনার ট্যাহা থাকব না। করোনা হউক আর না হউক আমাগো বাইর হওন লাগে। মাক্স থাইকলে কথা কওন যায় না। করোনা ওইলে আল্লায় দ্যাখবো।’
ঝালমুড়ি বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মামা মাস্ক লাগান তো বালা। মাস্ক তো লাগাই, কাম করতে করতে মুখ থ্যাইকা নাইমা যায়, থাকে না। সারা দিন কতক্ষণ রাহা যায় বলেন।’
সহকর্মীকে নিয়ে ঘুরতে আসেন আনসার সদস্য হায়দার আলী। তবে মুখে মাস্ক নেই। তিনি বলেন, ‘ঘোরাফিরা করছি তো তাই মাস্ক খুলি পকেট রাখছি। আর মালা মানসেই তো পরে নাই। আমরা পইরা কী অইব। তয় মাস্ক পরা উচিত।’
তবে ভিড় থেকে কিছু দূরে কাজ করা ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘মানুষের ভিড় দেখেই তো দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তাছাড়া স্বাস্থ্যবিধি দেখা তো আমাদের কাজ না। এটা থানার কাজ।
‘এত মানুষ মরতেছে, এত করোনা রোগী বাড়ছে, তবু কারও মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। দুই বছরেও মানুষ সচেতন না হইলে কবে হবে।’