গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সদ্য বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে।
২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের কোনাবাড়ি শাখায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে একটি চলতি হিসাব খোলেন জাহাঙ্গীর আলম। যার হিসাব নম্বর: ০৩৫১১১০০০০০৫৭৮।
নথিপত্র অনুযায়ী সিটি করপোরেশনে যে টাকা জমা পড়ার কথা, সেই টাকা জমা পড়েছে এই ব্যাংক হিসাবে। সেই টাকা তুলে নেয়া হয়েছে, যার একটি পয়সাও করপোরেশনের নথিতে তোলা হয়নি।
বিভিন্ন সময় অ্যাকাউন্টটিতে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২ কোটি ৬০ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৫ টাকা জমা হয়। এরপর ছয়টি চেকের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেয়া হয় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর কোনো হিসাবই সিটি করপোরেশনের রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।
এই ব্যাংক হিসাব খুলতে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেননি জাহাঙ্গীর। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দিলে তিনি করোনার অজুহাত দেখান। পরে ব্যাংক নিজে থেকে ব্যাংক হিসাবটি বন্ধ করে দিয়ে সাড়ে আট হাজার টাকা তাকে দিয়ে দেয়।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
নথিপত্রে দেখা যায়, ব্যাংক হিসাবে মোবাইল নম্বর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত নম্বর। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের। এক বছর তিন দিন চালু ছিল হিসাবটি।
তবে জাহাঙ্গীর আলমের দাবি, এই হিসাব তিনি খোলেননি। তাকে ফাঁদে ফেলতে একটি চক্রের কাজ। তিনি কাউকে চেক দেননি। কাউকে ব্যাংকে পাঠাননি।
যদিও ব্যাংক ম্যানেজার বলেছেন উল্টো কথা। তিনি জানান, টাকা ছাড় করানোর আগে যার নামে ব্যাংক হিসাব, তাকে ফোনও করা হয়েছে। তবে জাহাঙ্গীর ফোন পাওয়ার কথাও স্বীকার করতে চাননি।
ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার পর গত ১৯ নভেম্বর মেয়রের পদ হারান জাহাঙ্গীর। এরপর সিটি করপোরেশনে তার নানা অনিয়মের খবর আসতে থাকে গণমাধ্যমে।
কবে কত লেনদেন
হিসাবটি চালুর দিনই মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা জমা দেয় নগরীর কোনাবাড়িতে অবস্থিত ইস্পাহানি ফুডস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
কারখানা কর্তৃপক্ষ লে-আউট প্ল্যান অনুমোদনের ফি ও জরিমানা বাবদ ওই টাকা জমা দেয়। একই দিন অপর একটি পে-অর্ডারে জমা হয় আরও ৫০ লাখ টাকা।
ইস্পাহানি ফুডস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে পে-অর্ডার দিয়েছি। পে-অর্ডার না দিলে তো আমরা লে-আউট প্ল্যান পেতাম না। আমাদেরকে পে-অর্ডার ফি ও জরিমানা বাবদ সিটি করপোরেশন থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেভাবেই দিয়েছি। আমরা মেয়র গাজীপুর সিটি করপোরেশন বরাবর পে-অর্ডার দিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘নগর ভবনে গিয়ে মেয়রের কাছে পে-অর্ডারটি জমা দিই। পরে তিনি (মেয়র) একজন কর্মকর্তাকে ডেকে নিয়ে পে-অর্ডারটি জমা নিতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে একটি রিসিভ কপিও দেয়া হয়।
‘মেয়র যদি পে-অর্ডারটি রিসিভ না করতেন, তাহলে তো আমরা অনুমোদন পেতাম না। ফি জমা দেয়ার কিছুদিন পর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ি জোন থেকে ফোন করে লে-আউট অর্ডার অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে সেটি নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।’
একই বছরের ৫ মার্চ ১৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫ টাকার, ২৯ জুলাই ৮৫ লাখ ও ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯০ টাকার দুটি পে-অর্ডার জমা হয়।
এই হিসাব থেকে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৯৩৩২৮২৭ নম্বর চেকের মাধ্যমে শামীম হোসেন নামে একজনকে ৫০ লাখ টাকা দেন জাহাঙ্গীর আলম।
একই বছরের ৫ মার্চ ৯৩৩২৮২৮ নম্বর চেকের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা তোলেন জাহাঙ্গীর। ৬ আগস্ট ব্যক্তিগত কর্মচারী শহীদুলের মাধ্যমে ৫০৬১৯২ নম্বর চেকের মাধ্যমে এক কোটি টাকা, ১০ আগস্ট বাসার ব্যক্তিগত কর্মচারী প্লটু চাকমাকে দিয়ে ৫০৬১৯১ নম্বর চেকের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা এবং ১৮ ও ২০ আগস্ট ব্যক্তিগত কর্মচারী শহীদুলকে দিয়ে ৫০৬১৯৩ ও ৫০৬১৯৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে যথাক্রমে ৩০ লাখ ও ২০ লাখ টাকা তোলা হয়।
সর্বশেষ লেনদেনের প্রায় ৭ মাস পর প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকার কারণ দেখিয়ে ২০২১ সালে ৩ মার্চ হিসাবটি বন্ধ করে দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
তখন হিসাবটিতে জমা ছিল আট হাজার ২৩৫ টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আট হাজার পাঁচ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমকে ফেরত দিয়ে বাকি ২৩০ টাকা অ্যাকাউন্ট বন্ধের ফি হিসেবে কেটে নেয়।
হিসাব খোলায় মানা হয়নি নিয়ম
নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হলে পরিষদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কারও ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহারের বিধান নেই। হিসাবটি এককভাবে পরিচালনা করতে হলে পর্ষদ সদস্যদের নিয়ে মাসিক সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেজ্যুলেশনের কপি ব্যাংককে জমা দিতে হয়। কিন্তু অ্যাকাউন্টটি খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব নিয়মের কোনোটাই মানা হয়নি।
এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি এসেছে। তারা বিভিন্ন বিষয় তদন্ত করে দেখছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কথা বলব।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ বলেন, ‘আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অসংখ্য অনিয়মের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়গুলো যেহেতু মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে, তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
প্রিমিয়ার ব্যাংকের কোনাবাড়ি শাখার ব্যবস্থাপক এম মোর্শেদ খান বলেন, ‘হিসাবটি চালু ও বন্ধের সময় আমি এ শাখায় ছিলাম না। যেকোনো করপোরেশনের অ্যাকাউন্টে অবশ্যই দুজন অভিভাবক থাকতে হয়, এককভাবে হয় না। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করে তাদের রেজ্যুলেশনের ওপর। তাদের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় যেই সিদ্ধান্ত হয় তার ওপর। আমরা সেই সিদ্ধান্তের রেজ্যুলেশনের কপিও পাইনি। মূলত এই কারণেই অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
এই ব্যাংক হিসাবে টাকা লেনদেন নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে এক টাকা পেমেন্ট দিতে হলেও কাস্টমারের অনুমতি নিয়ে দিতে হয়। এই অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেও গ্রাহকের মোবাইল নম্বরে ফোন করে অনুমতি নিয়েই পেমেন্ট করা হয়েছে।’
জাহাঙ্গীরের দাবি, ফাঁদে পড়েছেন তিনি
নিউজবাংলার কাছে ব্যাংক হিসাব, লেনদেনের নথিপত্র থাকলেও এর সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘অ্যাকাউন্টটি আমার না। আমার নাম ব্যবহার করে, আমার ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে অ্যাকাউন্ট করে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এটা করেছে।
‘যাদেরকে বলা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত কর্মচারী, তারাও আমার ব্যক্তিগত না। অ্যাকাউন্ট খুলতে হলে রেজ্যুলেশন লাগে। আমার সরকারি স্বাক্ষর ও রেজ্যুলেশন না। আমি কোনো দিন ওই প্রতিষ্ঠানে (ব্যাংকে) যাইনি, ওই প্রতিষ্ঠানের কেউও আমার কাছে আসেনি।’
‘ব্যাংক অ্যাকাউন্টটিতে আপনার ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে’- এমন কথা শুনে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘যেকোনো মানুষ আমাদের নম্বর নেয়। ভোটার অফিসে আমার আইডি আছে, ইন্টারনেটে ছবি আছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে এসব ব্যবহার করতে পারছে। বেকায়দায় পড়ে গেছি তো তাই সবাই বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে।’
ব্যাংক হিসাবে নম্বর দেয়া থাকায় টাকা পরিশোধের সময় তো ফোন দেয়ার কথা- এমন মন্তব্যে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি। আমার রেকর্ডিংটা নাকি দুই বছর আগেই করা হয়েছে। আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্য একটা চক্র পূর্ব থেকেই কাজ করছে। আমি তাদের ফাঁন্দে পড়েছি।’
ব্যাংক নথি অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ লাখ টাকা আপনি নিজে উত্তোলন করেছেন- এই বিষয়টি বললে বহিষ্কৃত মেয়র বলেন, ‘ওই ব্যাংকে সিসি ক্যামেরা আছে। দেখেন আমি গেছি কি না সেখানে। আমি নিজে যদি টাকা উঠিয়ে থাকি তাহলে নিশ্চয়ই সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আমাকে দেখা যাবে।’
জাহাঙ্গীরের বক্তব্য নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের কোনাবাড়ি শাখার সে সময়ের ব্যবস্থাপক (বর্তমানে আশুলিয়া শাখায় কর্মরত) মোতালেব হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে অ্যাকাউন্টটি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম খুলেছিলেন। অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে তার স্বাক্ষর, ছবি ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড জমা নেয়া হয়। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় রেজ্যুলেশনের কপি চাওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। এর ভেতর বেশ কয়েকটি লেনদেন হয়ে যায়। পরে ডকুমেন্ট ত্রুটির কারণে আমরা অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিই।’
তিনি জানান, এই ব্যাংক হিসাব নিয়ে সে সময় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে তাদের একাধিক কথা হয়েছে।
তিনি বলেন, “তিনি (জাহাঙ্গীর) কখনো ‘করোনা পরিস্থিতিতে মিটিং হয় না’, ‘মিটিং হবে’, ‘রেজ্যুলেশন দিচ্ছি-দেব’ বলে কালক্ষেপণ করেন। এরপরে আমরা আর কোন পে-অর্ডার জমা নিইনি।
“তারা অনেক চেষ্টা করেছিলেন পে-অর্ডার জমা দেয়ার। কিন্তু আমরা নিইনি। পরবর্তীতে এক প্রকার জোরপূর্বক ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিই।”
অ্যাকাউন্টটি খোলেনি বলে বহিষ্কৃত মেয়র যে দাবি করেছেন- সেই প্রশ্নে মোতালেব হোসেন বলেন, ‘পে-অর্ডারের মালিক কি আমি? আমার কাছে পে-অর্ডার আসবে কোথা থেকে। সে সময় তার লোকজনই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এখন যদি তিনি অস্বীকার করেন তাহলে সেটা চ্যালেঞ্জ করা হবে। তদন্ত করলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। সে সময় আমরা ব্যাংক থেকে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলাম, সেসব তো জানা যাবে।’
ব্যাংক ব্যবস্থাপক এও জানান, প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিতে জাহাঙ্গীর আলমের বাসায়ও গেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “করোনা পরিস্থিতির সময় অন্তত ১০ দিন নগর ভবনে গিয়ে রেজ্যুলেশন হয়েছে কি না খবর নিয়েছি। মেয়রের বাসভবনে একাধিকবার গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছিলাম। দোতলায় বসে থাকতাম দেখা করতেন না। অনেক সময় দেখা হলে বলতাম, ‘আমরা অনেক সমস্যায় আছি, ডকুমেন্টগুলো জমা দেন।'”