বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কার্ড আটকে যান্ত্রিক ত্রুটিতে, টাকা কাটে গ্রাহকের

  •    
  • ৮ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:৪৯

টাকা তোলার সময় কার্ড আটকে যাওয়ার পর নতুন কার্ড নিতে বাধ্য হওয়া রফিকুল বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে কার্ডের চার্জ আমাদের দিতে হবে কেন? আমার ভুলে তো আর কার্ড আটকে যায়নি। মেশিনের ত্রুটির কারণে কার্ড আটকে গেছে। তাহলে অর্থদণ্ড কেন গ্রাহকের পকেট থেকে যাবে?’

রাত ২টা। হঠাৎ নিকটাত্মীয়ের ফোনে ঘুম ভেঙে বাসা থেকে বের হন রফিকুল ইসলাম। বাসার পাশেই ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলে গন্তব্য হাসপাতাল। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যায় আটকে গেল কার্ড। অনেকক্ষণ চেষ্টাতেও কার্ড অথবা টাকা কোনোটাই বের হলো না।

রফিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই রাতে টাকার খুব দরকার ছিল, কিন্তু পেলাম না। নেটওয়ার্ক যন্ত্রণা, মেশিন হ্যাং হওয়াসহ নানা কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কার্ড পেতে সময় লেগেছে সাত দিন। চেক না থাকায় ওই সাত দিন টাকা তোলা যায়নি। ধার করে চলতে হয়েছে।’

সেই কার্ড বিনা মূল্যে পাননি রফিক। তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে সে জন্য।

আইনজীবী নাহিদা খানমের ব্যাংক হিসাব আইএফআইসি ব্যাংকে। কার্ড আটকে যাওয়ার পর দুবার নতুন কার্ড নিতে হয়েছে তাকে। এ জন্য ৩০০ করে মোট ৬০০ টাকা কাটা হয়েছে তার ব্যাংক হিসাব থেকে।

বুথে কার্ড আটকে যাওয়ার কী কারণ, তার মধ্যে একটি ভুল পাসওয়ার্ড একাধিকবার দেয়া। এটি গ্রাহকের ভুল। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কার্ড আটকে যায় কারিগরি ত্রুটিতে, যাতে গ্রাহকের কোনো দায় থাকে না।

রফিক বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে কার্ডের চার্জ আমাদের দিতে হবে কেন? আমার ভুলে তো আর কার্ড আটকে যায়নি। মেশিনের ত্রুটির কারণে কার্ড আটকে গেছে। তাহলে অর্থদণ্ড কেন গ্রাহকের পকেট থেকে যাবে?’

সোনালী ব্যাংকের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তা এস এম কোরবান আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে বুথে কার্ড আটকে গেলে পুরোনো কার্ড গ্রাহকরা ফেরত পেতেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, বুথে আটকে গেলে গ্রাহক জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্ড ডেস্ট্রয় করতে হবে। পরে নতুন কার্ড ইস্যু করতে হয়।’

কারিগরি ত্রুটির দায় তো গ্রাহকের নয়। তাহলে তাকে কেন চার্জ দিতে হবে- এই প্রশ্নে এ ব্যাংকার বলেন, ‘সামান্য কিছু চার্জ। সেটা এমন কিছু নয়।’

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক সময় নেটওয়ার্কের কারণে কার্ড আটকে যায়। সাধারণত আবেদনের এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন কার্ড ইস্যু করা হয়। এতে সামান্য চার্জ দিতে হয়।’

সেই চার্জ ‘সামান্য’ হলে গ্রাহকের বদলে ব্যাংক কেন এর দায় নেবে না, সেই বিষয়টি আর বলেননি এই ব্যাংকার।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কার্ড আটকে গেলে নতুন কার্ড ইস্যু করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের পকেট কেটে চার্জ রাখা অন্যায়। কারণ এখানে তো গ্রাহকের ভুল নেই। বুথে সমস্যার কারণে কার্ড আটকে গেছে। তাহলে গ্রাহক টাকা দেবে কেন?’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম কার্ড আটকে যাওয়ার পুরো দায় দিয়েছেন গ্রাহকের ওপর। আর তার দৃষ্টিতে নতুন কার্ডের জন্য যে টাকা কাটা হয়, সেটা সামান্য।

এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় গ্রাহকরা কার্ডের পিন নম্বর ভুল দেয় বা একবারের জায়গায় তিনবার কার্ড পাঞ্চ দিয়ে ভুল করে, তখন তো কার্ড আটকে যাবে। এটাতে গ্রাহকের দায়। এ জন্য ব্যাংক তো কার্ড ফ্রি দেবে না। নতুন কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে সামান্য চার্জ নেয় এবং এই চার্জ গ্রাহকদের দিতে হবে।’

তবে বুথের কারিগরি ত্রুটির কারণে যে কার্ড আটকে যায়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র কিছু বলেননি।

দুর্ভোগের শেষ নেই

গ্রাহকদের সহজে সার্বক্ষণিক সেবা দিতে ব্যাংকগুলো চালু করেছে অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম সেবা। উদ্দেশ্য ২৪ ঘণ্টা সাত দিনই গ্রাহক পাবেন নিরবচ্ছিন্ন সেবা। অথচ বুথে টাকা তুলতে গ্রাহকের ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

নেটওয়ার্ক সমস্যা, কার্ড আটকে যাওয়া, টাকা না থাকা, টাকা বের না হওয়া, বুথ থেকে জাল-ছেঁড়া নোট বের হওয়াসহ নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। এ ছাড়া রয়েছে বুথের নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ। তবে বুথে কার্ড আটকে গেলে গ্রাহককে ভোগান্তি পোহাতে হয় সবচেয়ে বেশি।

নিয়ম অনুযায়ী বুথে কার্ড আটকে গেলে নিরাপত্তাকর্মীকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। পরে সেখানে থাকা রেজিস্টার্ড বইতে কার্ড আটকে যাওয়ার সময় ও বিষয় বিস্তারিত লিখে আলাদা একটি কাগজে গার্ডকে দিয়ে সই নেয়া হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে বিষয়টি জানানোর পর সর্বোচ্চ সাত কর্মদিবসের মধ্যে নতুন কার্ড ইস্যু করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ দিন বা এক মাস পার হলেও নতুন কার্ড মেলে না। বেশির ভাগ এটিএম বুথে গিয়ে গ্রাহকরা এসব অভিযোগ করলেও ব্যাংকগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কার্ড থাকার কারণে চেক বই এখন আর তোলা হয় না। কিন্তু কার্ড আটকে গেলে বিপদের শেষ থাকে না।’

কার্ড আটকে গেলে সেই টাকা ফিরে পেতেও আরও দুর্ভোগ। যে টাকা বুথে আটকে যাচ্ছে, তা ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয় ৭ থেকে ৫০ দিন। এমনকি সেই টাকা আর কখনও পাওয়া যায়নি- এমন অভিযোগও আছে।

সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল মামুন। ব্র্যাক ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের বুথ থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাব থেকে ১৫ হাজার টাকা তোলার চেষ্টা করেও পারেননি। তবে এসএমএস আসে, টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। পরে কাস্টমার কেয়ারে জানান তিনি। সেই টাকা ফেরত পান প্রায় দুই মাস পর।

রফিকুল আলম নামে একজন এই সমস্যায় পড়েছেন দুবার। ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে একবার টাকা ফেরত পেয়েছেন ৪৫ কর্মদিবস পর।

এখনও তার সাড়ে ৬ হাজার টাকা আটকে আছে। ব্যাংকের হেল্পলাইন থেকে বলা হয়েছে, তিন থেকে পাঁচ দিনের ভেতর টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু পাঁচ দিন পার হয়ে গেলেও এখনও টাকা আসেনি। কবে ফেরত পাবেন সেটিও জানেন না।

আটকে গেলেই নতুন এটিএম কার্ড

কার্ড ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০১৬ সালে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জানানো হয়, ব্যাংকের এটিএম বুথে কোনো গ্রাহকের কার্ড আটকে গেলে সরাসরি তা ফেরত না দিয়ে নতুন করে ইস্যু করতে হবে। গ্রাহকের আবেদনের সাত দিনের মধ্যে এ কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করার বাধ্যবাধকতাও জুড়ে দেয়া হয়।

আটকে যাওয়া কার্ডের তথ্য নিয়ে কেউ যেন জালিয়াতির সুযোগ না পায়, সে জন্য সতর্কতামূলক এ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর আগে এটিএম বুথে আটকে যাওয়া কার্ড ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের যে শাখায় অ্যাকাউন্ট রয়েছে ওই শাখা বা সুবিধামতো শাখায় পাঠানো হতো। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আটকে যাওয়া কার্ডটি ফেরত পেতেন গ্রাহক।

কিন্তু পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এটিএম বুথে কার্ড আটকে গেলে হুবহু ওই কার্ড ফেরত না দিয়ে নতুন কার্ড দিতে হবে।

কার্ড আটকে যায়, সমস্যা কার?

কারওয়ান বাজার মোড়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের বুথের সামনে কথা হয় মোর্শেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে কার্ড ব্যবহার করে আটকে গেছে পাঁচ-সাতবার। দুর্বল নেটওয়ার্কই এ ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে হয়।

তিনি বলেন, ‘ঠিকমতো কমান্ড করার পরও কার্ডে সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে স্মার্ট ব্যবস্থাপনা দরকার। আটকে গেলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ফেরত দেয়া দরকার।’

তসলিম সরদার নামে আরও একজন বলেন, ‘অনেক বুথই মেয়াদোত্তীর্ণ। রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ ব্যয় করা হয় না। কার্ড নিয়ে কমান্ড করলে অনেক সময় দীর্ঘ সময় নেয়। অনেক সময় টাকা আগে বের হয়, কার্ড পরে।

‘আবার কার্ড বের হলেও টাকা বের হয় না। রসিদও পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক অর্থ ব্যয় করে না। অথচ বছর শেষে ঠিকই কার্ড সেবা বাবদ অর্থ কেটে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দায় ব্যাংকের।’

অনেক সময় এক ব্যাংকের কার্ড অন্য ব্যাংকের বুথে দিলে আটকে যায়। অনভিজ্ঞ অনেক গ্রাহক এলোমেলো বাটন চাপ দেয়ার পরও আটকে যেতে পারে কার্ড।

আইটি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা

এটিএম বুথের কারিগরি ত্রুটির কারণে যেন কোনো গ্রাহকের কার্ড আটকে না যায় সে জন্য নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অনেক ব্যাংকই এই নির্দেশনা পরিপালনে উদাসীন বলে অভিযোগ আছে গ্রাহকদের।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলো তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ালেও সেটা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ থাকলেও অনেক ব্যাংক মানসম্মত এটিএম মেশিন আনে না।

আবার অনেক ব্যাংক এখনও এটিএম সেবার জন্য মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ এক্সপিসহ ২০০০, ২০০৭, ২০১০ এই ধরনের পুরোনো অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা নতুন করে আপডেট নিচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ব্যাংক টু ব্যাংক ভেরিফাই করে। কোন ব্যাংক কী ধরনের প্রযুক্তি, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করছে এটা সম্পূর্ণ এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ব্যাংকের সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্ক, ব্যাংকের জনবল কেমন, কোন পদ্ধতিতে কাজ করছে এ সবকিছু ভেরিফাই করে।’

এটিএম ও কার্ড সংখ্যা

১৯৯২ সালে দেশে প্রথম এটিএম বুথ চালু হয়। বর্তমানে সারা দেশে ১২ হাজার ৫৬৭টি এটিএম বুথ রয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৬৭টি শহরাঞ্চলে ও ৩ হাজার ৮০০টি গ্রামাঞ্চলে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রি-পেইড কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬৭টি।

এ বিভাগের আরো খবর