সিরাজগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যে চার যুবকের ছবি গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তাদের তিনজন যুবলীগের কর্মী বলে দাবি করেছে জেলা বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল। একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারছে না তারা।
তবে এই দাবিকে ভিত্তিহীন জানিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ বলছে, অস্ত্রধারীদের খুঁজছে তারাও।
এই যুবকদের মধ্যে একজনের বাড়ি খুঁজে পেয়েছে নিউজবাংলা। তবে তাকে বা তার স্বজন কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। অন্য দুজনের সম্পর্কে প্রতিবেশী বা এলাকাবাসীরা কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে ৩০ ডিসেম্বর শহরের ইসলামিয়া সরকারি কলেজ মাঠে সমাবেশের আয়োজন করে দলটি। এদিন দুপুরে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে। এতে আহত হন দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ। সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায় চার যুবককে।
এ ঘটনায় চার মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৮০০ জনকে। তিনটি মামলা করে পুলিশ, একটি স্থানীয় এক বাসিন্দা। কিন্তু ঘটনার দুদিন পেরোলেও ওই চার যুবকের সন্ধান পায়নি পুলিশ। বাহিনীটি বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে তাদের।
এমন পরিস্থিতিতে শনিবার দুপুরে জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, অস্ত্র হাতে দেখা যাওয়া চার যুবকের তিনজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে তারা।
নিউজবাংলাকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘ওরা যুবলীগের পক্ষে আমাদের কর্মীদের ওপর হামলা করেছে... এটা সবাই জানে। কাজেই আমরা ধরে নেব এরা যুবলীগের কর্মী। প্রকাশ্যে এমন আগ্নেয়াস্ত্র দেখে শহরবাসী উদ্বিগ্ন...স্তম্ভিত। দলের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে।’
জেলা ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কায়সার পারভেজ কাজল বলেন, ‘লাল-কালো গেঞ্জি পরা যে যুবক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি ছুড়েছেন, তার নাম বায়েজিদ আহমেদ, বাড়ি পৌর এলাকার একদালা মধ্যপাড়ায়। কালো গেঞ্জি পরা যুবকের নাম জনি আহমেদ, বাড়ি শহরের দত্তবাড়ি মহল্লায়। আর স্কাই ব্লু শার্ট পরা সুমন হোসেনের বাড়ি কালগয়লা মহল্লায়। অন্যজনকে এখনও শনাক্ত করতে পারিনি। তারা সবাই যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
এই তথ্যের পর তিন যুবকের খোঁজে শনিবার বিকেলে একদালা, দত্তবাড়ি ও কালগয়লা মহল্লায় যায় নিউজবাংলা।
একদালা মধ্যপাড়ায় এলাকাটি পৌরসভার ভেতরেই পড়েছে। বেশ ঘনবসতিই বলা চলে। রাস্তার পাশে একটি ভাপা পিঠার দোকান ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন নানা বয়সী জনাপাঁচেক মানুষ।
এখানে বায়েজিদ নাম, যুবলীগ করে- তার বাসাটা কোথায়?- এমন প্রশ্ন শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীণ বললেন, ‘চিনি না।’
অন্য কেউ কিছু বললেন না।
সেখান থেকে আনুমানিক ১০০ গজ দূরে পাওয়া গেল দুই যুবককে। একই প্রশ্নে একজন বলেন, ‘যুবলীগ করে কি না জানি না, তবে এই নামে একজন আছে।’
সেই যুবকই বায়েজিদের বাড়িটি দেখিয়ে দেন। তবে নিজের নাম জানাতে রাজি হলেন না।
বাড়িটি আধাপাকা; দেয়াল ইটের, ওপরে টিন। কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই।
দরজায় টোকা দিতেই বিপরীত একটি বাসার জানালা দিয়ে মধ্যবয়সী এক নারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চান।’
-‘এটা কি বায়েজিদের বাসা?’
-‘হ্যাঁ’।
-‘বাসায় কেউ আছে?’
-‘ওরা কেউ নাই।’
-‘কোথায় আছে জানেন?’
-‘না’।
বায়েজিদের মোবাইল নম্বর বা তার বাবার আছে?
তখন জবাব এলো, ‘না কিছুই নাই।’
এরপর দত্তবাড়ি এলাকায় খোঁজ চলে জনির। এই এলাকাটি বায়েজিদের বাড়ি থেকে আনুমানিক আড়াই শ গজ দূরে।
সেখানে এই নামে কাউকে শনাক্ত করতে না পারার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন দুজন।
‘জনি নাম, ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করে, কাউকে চেনেন কি না’- এমন প্রশ্নে একজন বলেন, ‘বাপের নাম বলেন’।
বাপের নাম বলতে পারছি না- এটা বলার পর সেই ব্যক্তি বলেন, ‘বাপের নাম বললে হয়তো চিনতে পারতাম। এমনিতে জনি নামে কাউকে চিনি না।’
এরপর যাত্রা আরও এক কিলোমিটার দূরের কালগয়লা এলাকায়। সেখানে গিয়েও সুমন নামে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এলাকার একটি উঁচু জায়গায় বসে থাকা চারজনের কাছে সুমন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারাও তার বাবার নাম জানতে চান। বলতে না পারায় তারাও শনাক্ত করতে পারেননি বলে জানান।
কিছু দূরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায় কয়েকজনকে। তারাও সুমন নামে কাউকে শানাক্ত করতে পারেননি।
একজন বলেন, ‘না, এই নামে কাউকে চিনলাম না তো।’
অস্ত্রধারীরা নিজেদের লোক নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) হোসেন আলী হাসান। শনিবার দুপুরে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অস্ত্রধারীরা আমাদের দলের কেউ নন। এমনকি আমি তাদের কোনোদিন দেখিনি। এ ছাড়া জেলা যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনও হয়নি।’
জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক একরাম হোসেন বলেন, ‘আমরা তাদের কাউকে চিনি না। যুবলীগের কর্মী বা সমর্থক হিসেবেও কোনোদিন দেখিনি। তাদের আমরাও খুঁজছি।’
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) হাসিবুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মিডিয়ায় প্রচার হওয়া ভিডিও ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। যদি কেউ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে থাকেন, তবে তাদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’