রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত চলা স্বাধীন পরিবহনে নিউ ইস্কাটনের বিয়াম গলি থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকা। দূরত্ব চার কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া হচ্ছে ৫ টাকা, হওয়ার কথা বড়জোড় ২ টাকা ২৫ পয়সা।
কিন্তু সরকার যে বাস ভাড়া ঠিক করেছে, তাতে ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা। তাহলে কেন ২০ টাকা নেয়? জবাব হলো, দুটি অবৈধ ওয়েবিল বসানো হয়েছে। একটি ওয়েবিল থেকে আরেকটির দূরত্ব দুই কিলোমিটার। তাতে সর্বনিম্ন ভাড়া আসে ১০ টাকা, সেই হিসাবে চার কিলোমিটারে দুটি ওয়েবিল বসিয়ে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
আরও অরাজকতা হলো, কেউ যদি বিয়াম গলির বদলে তার ৩০০ গজ আগের বাংলামোটর থেকে বাসে ওঠেন, তাহলে তাকে ভাড়া দিতে হচ্ছে তিনটি ওয়েবিলের। তখন চার কিলো ৩০০ মিটারের ভাড়া হয়ে যাচ্ছে ৩০ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারে সাড়ে ৭ টাকা।
- আরও পড়ুন: ঢাকায় বর্ধিত বাস ভাড়ারও দ্বিগুণ আদায়
ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর গত ৭ নভেম্বর যখন বাস ভাড়া বাড়ানো হয়, তখনই রাজধানীতে নানা কৌশলে আগে থেকেই নতুন নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি বাস ভাড়া আদায়ের বিষয়টি প্রকাশ পায়। সেই বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও বাড়তি আদায়ের কারণে কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিন গুণ হারে বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি সামনে আসে।
তখন সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ও বাস মালিকদের সংগঠন থেকে বলা হয়, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি টাকা নেয়া যাবে না, নিলে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
কিন্তু কঠোর ব্যবস্থার হুমকি এর আগের বহুবার করা উচ্চারণের মতোই ফেলনা হয়ে গেছে।
এর মধ্যে রাজধানীর বিশৃঙ্খল গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার ঘোষণা দিয়ে চালু হয়েছে বাসের নতুন এক ব্যবস্থাপনা। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়কে চালু হয়েছে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস সেবা। বলা হচ্ছে, এই সেবাই হবে নগরের আদর্শ। পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া এই সেবা ২০২৩ সালের মধ্যে চালু হবে পুরো রাজধানীতে।
- আরও পড়ুন: সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা, তবে বাসে উঠলেই ১৫
২৬ ডিসেম্বর এই সেবা চালুর আগে এটি নিয়ে যা যা বলা হয়েছিল, তার সবকিছুই এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটি বিষয়- এই পথের যাত্রীদের যে স্বস্তি দিচ্ছে, সেটি হলো বাস ভাড়া।
এই পথে যাত্রী ওঠার নির্ধারিত জায়গা আছে, এর বাইরে থেকে তোলা হয় না কাউকে। তবে অনুরোধ করলে নির্ধারিত জায়গা ছাড়াও নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেটি করার কথা না।
এই বিচ্যুতি ও অবকাঠামোগত নানা দুর্বলতা বাদ দিলেও একজন যাত্রী যেখান থেকেই উঠুন না কেন, তার কাছ থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ১০ টাকার বেশি ভাড়া দেয়া হচ্ছে না।
ঢাকা নগর পরিবহনে কিলোমিটার অনুযায়ী দূরত্ব ভেদে এভাবে ভাড়া নির্ধারিত হয়
আবার সেখানে ওয়েবিল নামে যাত্রী ঠকানোর কোনো পদ্ধতি নেই। ৪ দশমিক ৬৫ কিলোমিটারের পর যাত্রী যদি এক কিলোমিটার বেশি যান, তাহলে তার কাছে সর্বনিম্ন ছাড়া ১০ টাকার সঙ্গে যোগ হবে আরও ২ টাকা ১৫ পয়সা, যদি দুই কিলোমিটার বেশি যান, তাহলে ১০ টাকার সঙ্গে যোগ হবে ৪ টাকা ৩০ পয়সা। পয়সার হিসাব করা যায় না বলে টাকার হিসেবেই ভাড়া হয় এই বাসে।
ঘাটারচর থেকে চিটাগং রোড পর্যন্ত বাসটিতে ভ্রমণ করে দেখা গেছে, দূরত্ব ভেদে কোনো যাত্রীর ভাড়া হচ্ছে ১৩ টাকা, ১৪ টাকা, ২২ টাকা, ২৬ টাকা, ৩৭ টাকা ইত্যাদি। পুরো পথের ভাড়া ৫৯ টাকা।
- আরও পড়ুন: বাসে বাড়তি ভাড়া এক-দুই টাকার অভাবেও
ঢাকায় যাত্রীরা সাধারণত একটি নির্ধারিত দূরত্ব ভেদে ১০ টাকা, ১৫ টাকা, ২০ টাকা, ৩০ টাকা ইত্যাদি সংখ্যার ভাড়া দিয়ে অভ্যস্ত।
অর্থাৎ স্বাধীন পরিবহন যে পথে চলে, সেই রুটে যদি ঢাকা নগর পরিবহন চালু হয়, তাহলে বাংলামোটর থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া হবে ১০ টাকা। সেই যাত্রী যদি আরও এক কিলোমিটার দূরত্বে মেরুল-বাড্ডায় নামেন, তাহলে তাকে ভাড়া দিতে হবে ১২ টাকা। মেরুলের ইউলুপ দিয়ে সেই বাসটি যখন বনশ্রী যাবে, তখন ভাড়া হবে ১৪ টাকা।
বাড্ডার নতুনবাজার থেকে বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরত্বে রাইদা পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা। পরীক্ষামূলক রুটে নগর পরিবহন যে নীতিতে ভাড়া নিচ্ছে, সেই নীতিতে এই রুটে হবে ২০ টাকা।
৩০ টাকায় অবশ্য উত্তরা পর্যন্ত নেয় রাইদা। নগর পরিবহনে বাড়তি দুই কিলোমিটারে নগর পরিবহনে আরও ৪ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
ঢাকা নগর পরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য কম হারে ভাড়া নেয়া হয়
মগবাজার থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার পথের জন্য প্রভাতী বনশ্রী ভাড়া নিচ্ছে ৪০ টাকা। এই ভাড়ায় অবশ্য যাওয়া যায় উত্তরা পর্যন্ত।
কিন্তু নগর পরিবহনে এই রুটে ভাড়া হবে ৩০ টাকা, উত্তরায় গেলে ভাড়া দিতে হবে বাড়তি তিন কিলোমিটারের জন্য আরও ৬ টাকা।
- আরও পড়ুন: যাবেন মগবাজার, ভাড়া দেবেন মতিঝিলের
দুই সিটি করপোরেশনের বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের আওতায় এই নগর পরিবহনে ভাড়া কাটার পদ্ধতিটিও ভিন্ন। নগরে চলা অন্যান্য বাসে চালকের এক সহকারী যাত্রীদের কাছ থেকে হাতে হাতে টাকা তুললেও কোনো টিকিট দেন না। তবে নগর পরিবহনের বাসে ওঠার আগে কাউন্টার থেকে ই-টিকিট সংগ্রহ করতে হয় যাত্রীদের। এই ই-টিকিটই দূরত্ব থেকে কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণ বাসে মোড়ে মোড়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকেন যাত্রীরা। চাপ বেশি থাকলে বাস আসতেই হুড়োহুড়ি করে উঠতে হয়, শৃঙ্খলার থাকে না বালাই। অন্যদিকে নগর পরিবহনে যাত্রীরা লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকেন। সুশৃঙ্খলভাবে বাসে ওঠেন তারা।
যেখানে-সেখানে হাত তুললেই দাঁড়ায় ঢাকার যেকোনো রুটের বাস। তবে নগর পরিবহনে সে সুযোগ নেই। যেখানে-সেখানে নামার বিষয়টিও কেবল যানজট হলে অনুরোধের ওপর নির্ভর করে।
রাজধানীতে চলা বাসগুলোয় যে চালক, কে সহকারী বোঝার উপায় নেই। নগর পরিবহনে চালকের গায়ে থাকে নির্ধারিত পোশাক, সঙ্গে ঝোলানো থাকে পরিচয়পত্র।
নিষিদ্ধ থাকলেও পথের মধ্যে চালক ও সহকারীর ধূমপান চলতে থাক দেদার। যাত্রীদের এই প্রবণতা এখন না থাকলেও চালক-শ্রমিকরা নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইছেন না। তবে নগর পরিবহনে এই চিত্র দেখা যায় না।
- আরও পড়ুন: বাসে যাত্রী ঠকানোর ‘ওয়েবিল’
ঢাকা কলেজের ছাত্র সুমন মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ছাত্র পরিচয় দিলেই তারা অর্ধেক ভাড়া নেন। এই বাসে তুলনামূলক ভাড়া কম লাগে। কন্ডাক্টরের সঙ্গে বাস ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করা লাগে না।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ২৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ বাস রুট পাইলটিংয়ের উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে সচিবালয় থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
- আরও পড়ুন: ওয়েবিলে বাস চলবে না: মালিক সমিতি
সেখানে মন্ত্রী বলেন, ‘ঘাটারচর-কাঁচপুরের পর রাজধানী ও আশপাশের চারটি জেলার আরও ৪২টি রুটে নগর পরিবহন নামে বাসের নতুন ব্যবস্থাপনা চালু হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো নগরীকেই এই সেবার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।’
এই পরিবহন সেবায় যুক্ত হতে আটটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে বিআরটিসিসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।
অবশ্য এই সেবায় সব নতুন বাস দেয়ার কথা থাকলেও ট্রান্স সিলভার পুরোনো বাস দেয়া নিয়ে সমালোচনা আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস অবশ্য শুরুর দিকে সমালোচনাকেই প্রধান না করার অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, অনেক কষ্ট করে নতুন একটি সেবা আনতে যাচ্ছেন তারা। শুরুতে কিছুটা ভুলত্রুটি থাকবে। সেগুলো শুধরে নিয়ে নগরে একটি সুশৃঙ্খল চলাচলের ব্যবস্থা তারা করবেন।
ঢাকা বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনার এ চিন্তাটি সামনে আনেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক।