একটি জাতীয় দৈনিকের একজন সাংবাদিক ছেলেকে ভর্তি করতে গত ১২ ডিসেম্বর যান একটি স্কুলে। তার বেতন যায় ঢাকা ব্যাংকে। স্কুলের পাশে বুথ এবি ব্যাংকের। ছেলের ভর্তির জন্য ২০ হাজার টাকা তোলার চেষ্টা করেন। ব্যাংক থেকে কেটে নেয়া হয় টাকা, কিন্তু মেশিন থেকে আর বের হয় না।
সেই সাংবাদিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকে ফোন দিলাম, বলে চার সপ্তাহ লাগবে।’
এত সময় লাগার কারণ কী সেটি বলেছে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে ব্যাখ্যা দেয়নি। বলে প্রক্রিয়া চলমান আছে।’
এরপর নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্টে থাকা কিছু টাকা, সঙ্গে স্ত্রীর হাতে থাকা টাকাসহ নানাভাবে ২০ হাজার টাকা মিলিয়ে স্কুলের ফি দিয়ে আসেন।
এই বাড়তি টাকা ছিল সংসার চালানোর। সেই টাকা বাচ্চার স্কুলে দেয়ার পর ঋণ করে মাসের বাকি সময় চলতে হচ্ছে। এর মধ্যে তিনি বিকাশ থেকে ধার করেছেন তিন হাজার টাকা।
ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বুথ থেকে টাকা তোলার পদ্ধতি আসার পর ব্যাংকে লাইনের যন্ত্রণার উপসম হয়েছে বটে। তবে ব্যাংকের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায়ই টাকা আটকে যাচ্ছে; তৈরি হয়েছে নতুন ভোগান্তি। যে টাকা বুথে আটকে যাচ্ছে তা ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয় ৭ থেকে ৫০ দিন।
নিয়ম অনুযায়ী টাকা কেটে নেয়ার পরেও বুথ থেকে বের না হলে সঙ্গে সঙ্গে বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডকে জানাতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমার কেয়ারকেও যত দ্রুত জানাতে হয়।
ব্যাংকের হোম ব্রাঞ্চে একটি লিখিত অভিযোগও নেয়া হয়। সেখানে হিসাবধারীর নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর, বুথের ঠিকানা, টাকার পরিমাণ, টাকা উত্তোলনের তারিখ এবং সময়, যোগাযোগের নম্বর এবং সই থাকতে হয়। অভিযোগ দেয়ার সময় ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটি তাকেও জানাতে হবে।
কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ দেয়ার ১৫ দিন বা এক মাস পার হলেও টাকা মেলে না।
সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল মামুন। ব্র্যাক ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের বুথ থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাব থেকে ১৫ হাজার টাকা তোলার চেষ্টা করেও পারেননি। তবে এসএমএস আসে, টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। পরে কাস্টমার কেয়ারে জানান তিনি। সেই টাকা ফেরত পান প্রায় দুই মাস পরে।
রফিকুল আলম নামে একজন এই সমস্যায় পড়েছেন দুইবার। ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে একবার টাকা ফেরত পেয়েছেন ৪৫ কর্মদিবস পরে।
এখনও তার সাড়ে ৬ হাজার টাকা আটকে আছে। ব্যাংকের হেল্পলাইন থেকে বলা হয়েছে, ৩ থেকে ৫ দিনের ভেতর টাকা ফেরত দেবে।
‘কিন্তু ৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখনও টাকা আসেনি। কবে ফেরত পাব জানি না’-নিউজবাংলাকে বলেন রফিকুল।
বিষয়টি অহরহ ঘটছে। গ্রাহকরা টাকা তুলতে গেলে কারিগরি জটিলতায় নানা সময় দেখা যায় টাকা বের হচ্ছে না। ব্যাংককে জানালে তারা ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানায়। কিন্তু সেটি নিতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেক বেশি।
বিশেষ করে যারা সীমিত টাকা দিয়ে চলেন, মাসের শেষে তারা এই সমস্যা তৈরি হলে সেটি পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।
গ্রাহকের প্রশ্ন, এটিএম বুথের পুরো বিষয়টি অটোমেটেড থাকার কথা। সেখানে টাকা বের না হলে তার তথ্য পেতে এত দেরি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাহলে ব্যাংকে গ্রাহকের হিসাবে তা পাঠাতে কেন এত সময় লাগবে।
কী বলছেন ব্যাংকাররা
ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে যেটি জানিয়েছেন, সেটি হলো কোম্পানিগুলো তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ালেও সেটা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ থাকলেও অনেক ব্যাংক মানসম্মত এটিএম মেশিন আনে না। আবার অনেক ব্যাংক এখনও এটিএম সেবার জন্য মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ এক্সপিসহ ২০০০, ২০০৭, ২০১০ এই ধরনের পুরোনো অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা নতুন করে আপডেট নিচ্ছে না।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো প্রযুক্তিগতভাবে খুব বেশি এগোতে পারেনি। আমাদের দেশের ব্যাংকের আকার ছোট, সম্পদ কম। এ জন্য এ খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় করার সামর্থ্য ব্যাংকের নেই। আমাদের যে ব্যাংকগুলো ছোট, মূলধন কম, তাদের জন্য প্রযুক্তি খাতের বিশাল ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন। আপডেট প্রযুক্তি ব্যবহার না করার ফলে এসব সমস্যা হচ্ছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহক।’
ডাচ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করি। কখনও কখনও হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে দেরি হতে পারে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোন ব্যাংক কী ধরনের প্রযুক্তি, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করছে এটা সম্পূর্ণ এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ব্যাংকের সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্ক, ব্যাংকের জনবল কেমন, কোন পদ্ধতিতে কাজ করছে এ সবকিছু ভেরিফাই করে।’
তিনি বলেন, ‘এটা ব্যাংক টু ব্যাংক ভেরিফাই করে। কিছু ব্যাংক সঙ্গে সঙ্গে টাকা ফেরত দেয়। অনেক সময় মনিটরিংয়েও সময় বেশি লাগে। সপ্তাহে এক দিন হয়তো শাখাতে নোটিশ যায়, নোট দিতে হয়। এসব প্রক্রিয়াগত কারণে সময় চলে যায়।’
১৯৯২ সালে দেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) চালু হয়। বর্তমানে সারা দেশে ১২ হাজার ৫৬৭টি এটিএম বুথ রয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৬৭টি শহরাঞ্চলে ও ৩ হাজার ৮০০টি গ্রামাঞ্চলে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬৭টি।