মঞ্চের সামনে অনেকগুলো চেয়ারের সারি। সামনের কয়েকটি সারির চেয়ারে সাদা পরিপাটি আবরণ লাগান। চেয়ারের নিচে কার্পেট। সাইনবোর্ড বসিয়ে জানান হচ্ছে- এই চেয়ারগুলো রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতা ও বিশিষ্টজনের জন্য সংরক্ষিত।পেছনের সারির প্লাস্টিকের চেয়ারগুলোতে কোনো পর্দা নেই। নিচে কার্পেটও নেই। নিরাবরণ এসব চেয়ার সংরক্ষিত রাখা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ও সিলেট জেলা পরিষদের সহায়তায় সিলেটে সোমবার আয়োজন করা হয় আঞ্চলিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের। মধ্যরাত পর্যন্ত চলা এ অনুষ্ঠানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকার পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।এই অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনের সারির পর্দাবিহীন চেয়ারে বসানো নিয়ে চলছে সমালোচনা। অনেকেই বিষয়টিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান হিসেবেও অভিহিত করেছেন।তবে এমন সমালোচনা বস্তুনিষ্ঠ নয় বলে দাবি করছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম। তার দাবি, সামনের আসনেও মুক্তিযোদ্ধারা বসা ছিলেন। তবে একপাশের ছবি তুলে সমালোচনা করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ীই আসন বিন্যাস করা হয়েছিল।বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশটি শুরু হয় বিকাল ৪টায়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মতিয়ার রহমান হালদার। সমাবেশের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় ব্যান্ড দল চিরকুট, আঁখি আলমগীর, পিন্টু ঘোষ সঙ্গীত পরিবেশন করেন।ফেসবুকে অনুষ্ঠানটির কিছু ছবি দিয়ে সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকারামুল কবির লেখেন, ‘সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে আঞ্চলিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নরমাল প্লাস্টিকের চেয়ার আর রাজনীতিবিদদের জন্য রাজকীয় সফেদ চেয়ার।’এই পোস্টে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এমন ব্যবহারের নিন্দা জানান। আয়োজনকদের সমালোচনাও করেন তারা।ওই পোস্টে সাংবাদিক খালেদ আহমদ লেখেন, ‘বাইরে বাইরে সম্মান, ভেতর চেতনা শূন্য। শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ অবহেলা।’এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কবি সজল ছত্রী ফেসবুকে লেখেন, ‘সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার নামে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনের সারিতে বসিয়ে নিজেরা সামনের সারি আর মঞ্চে বসেছেন তাদের সবাইকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। নেতা আমলারা অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য বেয়াদবি করেছেন।’
ফেসবুকে ছড়ানো ছবিতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও। সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের আহ্বায়ক গুলজার খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন করে দিয়েছি এখন আর আমাদের স্মরণ করার দরকারই নেই। আমাদেরকে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই বসান হোক।’এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ভবতোষ বর্মণ রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই অনুচিত হয়েছে। আমি অনুষ্ঠানের সামনের সারিতে ছিলাম। মাঠে অনেক রোদ ছিল। ফলে পেছনের আসন বিন্যাসগুলো দেখিনি। পরে ফেসবুকে ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই ফোন দিয়ে এ ব্যাপারে আমার কাছে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।’তবে আসন বিন্যাসের পেছনের অংশটুকু বাদ দিলে আয়োজনটিতে প্রশাসনের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না বলেও মন্তব্য করেন ভবতোষ বর্মণ। তিনি বলেন, ‘আলোচনা পর্বে সভাপতি ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক। তবে তিনি স্বাগত বক্তব্য দিয়েই নিজের আসন ছেড়ে এসে আমাকে এই আসনে বসিয়ে দেন। আমি মনে করি এটা সব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিই সম্মান প্রদর্শন।’
সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব জায়গায় যেমন রাজাকারের সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা আছে, তেমন সিলেটের জেলা প্রশাসক কার্যালয়েও এমন লোক আছে। তারাই এমন কাজ করেছে। তবে অনুষ্ঠানস্থলেই জেলা প্রশাসক এ জন্য আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাঠে দুই হাজার চেয়ার ছিল। সবগুলোতে পর্দা লাগানো সম্ভব হয়নি। সামনের আসনগুলোতেও মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। পেছনেও ছিলেন। এখন মাঠের আংশিক অংশের ছবি তুলে সমালোচনা করা হচ্ছে।’তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের অসম্মান করার প্রশ্নই ওঠে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে আমি নিজের আসনও ছেড়ে দিয়েছি।’