বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলে বড় দরপতন হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৪ ডলার বা সাড়ে ৫ শতাংশ কমে ৬৬ ডলারে নেমে এসেছে।
জ্বালানি তেলের এই দর ২০২০ সালের এপ্রিলের পর সবচেয়ে কম। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরে দ্বিতীয় বড় দরপতন এটি।
এর আগে গত ২৭ নভেম্বর দাম ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলার ২২ সেন্ট বা ১৩ শতাংশের বেশি কমে ৬৮ ডলারে নেমে এসেছিল। এরপর ওমিক্রন আতঙ্ক কিছুটা স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় তেলের দাম বেড়ে ৭০ ডলারের ওপরে উঠে গিয়েছিল। দুই সপ্তাহ ধরে ৭০ ডলার বা তার কাছাকাছি অবস্থান করছিল। সোমবার তা এক লাফে ৬৬ ডলার ৯১ সেন্টে নেমে এসেছে।
কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন ওমিক্রন আতঙ্কের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও কমে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন বিদুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ায় তেলের দরে এই পতন হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বাজারে তেলের জোগান বাড়ানোয় দরপতনের আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
বার্তা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়ায় তেলের দাম কমে যাচ্ছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে শীতকালীন ছুটিতে ভাইরাসটি আরও ছড়িয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করেছে নেদারল্যান্ডস।
তবে ডিলাররা পরপর দ্বিতীয় সপ্তাহে তেলের জোগান বাড়িয়েছে। আর চাহিদা কমার পাশাপাশি সরবরাহ বৃদ্ধি তেলের দাম কমাচ্ছে।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত ডব্লিউটিআই তেল ৬৬ ডলার ৯১ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। এই দর আগের দিনের চেয়ে ৩ ডলার ৯৫ সেন্ট বা ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৪ ডলার ২২ সেন্ট বা ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে ৭০ ডলার ৩০ সেন্টে বিক্রি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। কমে যেতে পারে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। তার ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের চাহিদাও কমে যেতে পারে। আর এই কারণেই তেলের দাম কমছে।
গত ২৩ নভেম্বর জ্বালানি তেলের দাম কমাতে নিজ দেশের পেট্রোলিয়াম ভান্ডার থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
গত ২৭ অক্টোবর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে ৮৫ দশমিক শূন্য ৭ ডলারে ওঠে। এর পর থেকেই তা কমতে থাকে। ৮ নভেম্বর এর দর ছিল ৮২ দশমিক ৫ ডলার। এক মাস আগে ১৬ অক্টোবর দাম ছিল ৮০ ডলার। আর এক বছর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের জানুয়ারি মাসে জ্বালানি তেলের দাম ছিল গড়ে প্রতি ব্যারেল ৪৯ ডলার। এর পর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে মাসে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছিল, শিগগিরই তা ১০০ ডলার হয়ে যেতে পারে।
গত নভেম্বর থেকে দাম নিম্নমুখী হয়। তার পরও দামটা নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনতে নিজ দেশের পেট্রোলিয়াম ভান্ডার থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গত ২৩ নভেম্বর টুইট বার্তায় বাইডেন ঘোষণা দেন, ‘আমেরিকান পরিবারগুলোর জন্য তেল ও গ্যাসের দাম কমাতে পদক্ষেপের কথা আজ ঘোষণা করছি। আমেরিকাবাসীর জন্য স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (এসপিআর) থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল ছাড়ব আমরা, যাতে তেল ও গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে।’
দেশে তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি রুখতে এই পদক্ষেপ নেন জো বাইডেন। এর জেরে সে দেশে জ্বালানির দাম কমবে বলে মনে করা হচ্ছিল। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দামেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছিলেন অনেকে।
তবে বাইডেনের এই ঘোষণার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম খুব একটা কমেনি।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে গত ৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
নভেম্বরের শেষে তেলের দরে বড় দরপতন হলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘তেলের দর কমা অব্যাহত থাকলে দেশের বাজারেও সমন্বয় করা হবে।’