বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুরুষের ছদ্মবেশে একাত্তরের রণাঙ্গনে

  •    
  • ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:২৬

৯ এপ্রিল পাবনার নগরবাড়ী ঘাটের কাছে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্ব যাকে দেয়া হয়, তিনি পুরুষের ছদ্মবেশ নেয়া এক নারী যোদ্ধা। নাম শিরিন বানু মিতিল। নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরের যুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করেছিলেন এই যোদ্ধা। একাত্তরে যুদ্ধের শুরুতেই তাকে নিয়ে দেশে-দেশের বাইরে কৌতূহল দেখা দেয়। 

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিরিন বানু মিতিলের দুই ফুফাতো ভাই জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে। ২১ বছরের তরুণী মিতিল ঘরে বসে থাকতে পারেননি। ফুফাতো ভাইদের পোশাক পরে, শার্ট-প্যান্ট পরে কিশোর যোদ্ধার বেশে যুদ্ধে চলে যান তিনি।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাবনা আক্রমণ করলে ২১ বছর বয়সী মিতিল এক আত্মীয়ের কাছে মাত্র ৩০ মিনিটে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালানো শিখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হানাদার রুখতে।

লড়াকু মিতিলের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘আ শাই গার্ল উইথ এ গান’। মিতিলের কথা শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরে আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকেও দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগঘন কণ্ঠে প্রচারিত হয় বিশেষ প্রতিবেদনটি।

যারা পাকিস্তানি দখলদারদের তাড়াতে লড়ছিল বিভিন্ন রণাঙ্গনে, তাদের সবার জন্য এ খবর ছিল অনুপ্রেরণা।

১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরে জন্মেছিলেন শিরিন বানু মিতিল। পিতা বামপন্থি রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ খন্দকার মোহাম্মদ শাহজাহান। মা সেলিনা বানুও বামপন্থি রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও পূর্ব বাংলার আইন সভার সাবেক সদস্য।

মাতামহ খান বাহাদুর ওয়াসিমউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক আদর্শ মিতিলকে প্রভাবিত করে। কৈশোরের সূচনা থেকেই মুক্ত চেতনার আবহে বিকশিত হয়ে উঠেছিল তার রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। সেই সঙ্গে ছিল প্রগাঢ় দেশপ্রম। আর দশটি তরুণীর মতো ছকে বাঁধা জীবনের বাসনা শিরিন লালন করেননি।

মাতামহের বাড়িটি ছিল একসময় বামপন্থিদের শক্ত ঘাঁটি। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই পাবনায় শত শত শিক্ষার্থীর সামরিক মহড়া শুরু হয়। সর্বস্তরের লোকজনকে সংগঠিত করার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সক্রিয় ছিল। ২৫ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধ আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সে কেন্দ্রে একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যুক্ত হন শিরীন বানু মিতিল। তাকে এভাবে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন পাবনার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার হাইকমান্ডের সদস্য বাম নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পাবনাও পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জারি হয় সান্ধ্য আইন। ২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার।

পাবনায় প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই। চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ২৭ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনসে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে। তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, এসিড বাল্ব, বঁটি আর দা।

শিরিনের সহযোদ্ধা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি বলেন, ‘২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনসে প্রতিরোধ যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। সেই যুদ্ধে শিরিন বানু মিতিল বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষ বেশে অংশ নেন। পরদিন পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে জনতার তুমুল যুদ্ধ হয়, যাতে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।’

মুক্ত পাবনায় ৩১ মার্চ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম বসানো হয়। ৯ এপ্রিল পাবনার নগরবাড়ী ঘাটের কাছে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয় মিতিলকে। এ ছাড়া নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরের যুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে। পাবনার পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া জেলায় তখন প্রতিরোধ প্রায় ভেঙে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন চুয়াডাঙ্গার দিকে চলে যান।

কমিউনিস্ট নেতা জসিম মণ্ডলের সঙ্গে শিরিন বানু মিতিল ও তার সহযোদ্ধা রবিউল ইসলাম রবি

বামপন্থি নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও মিতিল পরে কুষ্টিয়া হয়ে ভারতে চলে যান। পথে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের। কিছুদিন পর ভারতের দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপেন। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন তোলায় পুরুষের ছদ্মবেশে যুদ্ধ করার আর সুযোগ পাননি মিতিল।

এ সময় শিরিন বানু মিতিল নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় ছিলেন কিছুদিন। প্রথমে বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন। এ রকম মোট ৩৬ জন নারী নিয়ে ভারতের গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একপর্যায়ে সদস্য ২৪০ ছাড়িয়ে যায়।

অস্ত্রের অভাব থাকায় নারীদের সবার হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য, কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যান। সেখানকার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়ায় নৃবিজ্ঞানে পাঠ সমাপ্ত করে ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন। শিরিন চাইল্ড অব মাদার কেয়ার নামে একটি সেবাকেন্দ্রের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিরিন ‘প্রিপ ট্রাস্ট’ নামের এনজিওর পরিচালক হিসেবে অ্যারোমা দত্তের সঙ্গে কাজ করেন। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

রণাঙ্গনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন অনেকটাই বিস্মৃতপ্রায়। তার স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নেই এমনকি তার নিজ জেলার রাজনৈতিক বিচরণক্ষেত্র এডওয়ার্ড কলেজেও। এ নিয়ে হতাশ তার সহযোদ্ধারা।

সহযোদ্ধা সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমেদ বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর এই অসামান্য মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযোগ্য সম্মান দেয়া হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। জীবিত থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থগিত করে রাখা হয়েছিল তার নাম। এখন তো আর কেউ স্মরণও করে না। অথচ তার বীরত্বগাথা পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ার দাবি রাখে।’

মুক্তিযোদ্ধা মিতিলের ফুফাতো ভাই পাবনা পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট তসলিম হাসান সুমন বলেন, ‘পাবনায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামে প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিকেন্দ্র করা হয়েছে। কিন্তু শিরিন বানু মিতিলের স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে তার স্মৃতি ধরে রাখতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে তার নামে হল ও স্মৃতিকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানাই।’

এ বিভাগের আরো খবর