বিলজুড়েই দেখা মেলে নানা রঙের পাখির। শোনা যায় সেগুলোর কিচিরমিচির। সব ক’টির নামও জানা যায় না। বিলের স্বচ্ছ জলের ওপর দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা।
নওগাঁর সাপাহার উপজলোর ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য।
ঋতুবৈচিত্র্যে এখনও হেমন্ত চলছে, তবে প্রকৃতিতে বইতে শুরু করেছে শীতের হাওয়া। শীত শুরু হতেই দেশের জলাশয়গুলোয় ভিড় করে অতিথি পাখি। দূরের পথ পেরিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে সেগুলো। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। শীতের হাওয়া বইতেই জবই বিলে ভিড় করেছে অসংখ্য অতিথি পাখি।
রাশিয়া, সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশ থেকে হাজারও পাখি এসে জড়ো হয়েছে এখানে। এই বিল যেন এখন পাখিদের অভয়ারণ্য।
জবই বিলে গিয়ে দেখা যায়, টলমল করছে বিলের স্বচ্ছ পানি। আর ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখির দল। বালিহাঁস, সরালিহাঁস, পানকৌড়ি, পিয়াংহাঁস, পাতি সরাল, লেংজাহাঁস, ছন্নিহাঁস, পাতিকূট, শামুকখোলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখিতে মুখরিত ছিল বিল।
গত বছরও একশ্রেণির মানুষ অবাধে এসব পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করেছে। তবে এ বছর থেকে উপজলো প্রশাসনের উদ্যোগ আর স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সদস্যদের নজরদারিতে বিল এলাকায় পাখি শিকার বন্ধ রয়েছে। ফলে এবার বেড়েছে পাখির সমাগম।
পাখির কলকাকলী দেখতে প্রতিদিন বিলের দুপাড়ে ভিড় জমাচ্ছে নানা বয়সের মানুষ।
সাপাহার ডাকবাংলো এলাকা থেকে পাখি দেখতে আসা সিহাব হোসেন বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার পরিযায়ী পাখির সমাগম বেশি। জবই বিলে এসেছি পরিবার নিয়ে। একসঙ্গে এতগুলো দেশি-বিদেশি পাখি এর আগে দেখা হয়নি।’
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী সাবিনা হক বলেন, ‘কত রকমের কত সুন্দর পাখিগুলো বিলে ডানা মেলে খেলা করছে। আবার অনেক পাখি আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। কি চমৎকার দৃশ্য। দেখে মন জুড়িয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘পাখিগুলো যেন কেউ শিকার করতে না পারে, সেদিকে প্রশাসনসহ সবার নজরদারি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বিলের পাশে রাস্তার দুই ধারে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা উচিত। তা হলে আরও অনেক মানুষের আগমন ঘটবে এখানে।’
দেশি-বিদেশি নানা ধরনের পাখি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় দর্শকের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জবই বিলে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা না থাকায় একসময় বিলে পাখি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত বছর থেকে এলাকার কিছু যুবক জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন তৈরি করে বিলে অতিথি পাখিসহ সব ধরনের পাখি শিকার বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এ ছাড়া মৎস্যজীবীরা খরা মৌসুমে বিলের পানি শুকিয়ে গেলে মা মাছগুলো রক্ষায় বিলের মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় বাঁশ, কাঠ ও কিছু কচুরিপানা দিয়ে একটি করে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলেন, খরা মৌসুমে মা মাছগুলো যাতে ওই স্থানে লুকিয়ে থাকতে পারে। এ উদ্যোগের কারণে এবার শীত মৌসুমে দেশি-বিদেশি পাখিরা অবাধে বিলে আসতে শুরু করেছে।
উপজেলা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘ভবিষ্যতে বিলের বিশাল অংশে কচুরিপানা দিয়ে মাছসহ পাখিদের বড় ধরনের অভয়াশ্রম এবং বিলের দ্বীপগুলোয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল তৈরি করলে সারা বছর বিলে পাখিদের আনাগোনা থাকবে।
‘জবই বিল আবারও ফিরে পাবে তার ঐতিহ্য। এ ছাড়া বিলের যেকোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে পাখির অভয়াশ্রম তৈরি করে সে স্থানে মাছ শিকার করা বন্ধ রাখলে পাখিগুলো নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের জরিপ অনুযায়ী জবই বিলে দেশি ও বিদেশি মিলে মোট ৯ হাজার ৭১২টি পাখি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক পাখিপ্রেমী পাখির সৌন্দর্য অবলোকন করতে বিল এলাকায় ভিড় করছেন। বিলপাড়ে পর্যটকদের জন্য ঘোরাফেরা ও বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হলে ভবিষ্যতে সাপাহারের এই জবই বিলটি এ এলাকার পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিতে পারে।’
নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জবই বিলকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, ‘জবই বিলে এখন দেশি-বিদেশি অনেক পাখির আগমন ঘটেছে। কেউ যাতে পাখিগুলো শিকার করতে না পারে এবং অবৈধভাবে বিলে মাছ শিকার করার কারণে পাখিরা যাতে উড়ে না যায়, সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি আছে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জবই বিলের পাশে যে রাস্তা আছে, সেই রাস্তার দুই পাশে যাতে দর্শনার্থীরা বসতে পারে, সেটাসহ আরও কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে তার পরিকল্পনা করছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। আশা করছি, দ্রুত কাজগুলো বাস্তবায়ন হবে।