যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন। আওয়ামী লীগের দলীয় পদ হারানোর ধাক্কা কাটতে না-কাটতেই গাজীপুরের মেয়র পদও গেল। আর এই দুই সিদ্ধান্তে এতদিন তার একনিষ্ঠ ভক্ত-সমর্থক হিসেবে পরিচিতরাও কি হারিয়ে গেলেন?
গাজীপুরের হারিক্যান ছয়দানা এলাকায় জাহাঙ্গীর আলমের বাসায় গেলে এটা মনে হতেই পারে। যখন দল ছিল, পদ ছিল, সে সময় এই বাড়িটি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকত গমগম, এখন যেন হাহাকার।
শুরুটা এই বাড়িতেই হয়েছিল। ঘরোয়া এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে জাহাঙ্গীর এমন সব কথাবার্তা বলেছিলেন, যে ধরনের কথা বলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মামলার আসামি হয়েছেন বছর আটেক আগেই।
ঘরোয়া সেই আলোচনা আর গোপন থাকেনি। সেপ্টেম্বরে কিছুটা অডিও, কিছুটা ভিডিও আকারে ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। রেকর্ডকে বানোয়াট, সুপার এডিট ইত্যাদি নানা কথা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জাহাঙ্গীর। দলের দেয়া কারণ দর্শানো নোটিশেও উল্লেখ করেন একই কথা। কিন্তু বিশ্বাস করেনি তার দল।
ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করে নগর আওয়ামী লীগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যাওয়া জাহাঙ্গীরকে ছেঁটে ফেলতে দুবার ভাবেনি দল।
সিদ্ধান্ত আসে গত ১৯ নভেম্বর। তার আগে থেকেই যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে ইঙ্গিত প্রকাশ হচ্ছিল, তখন থেকেই গাজীপুরের ‘মেয়র বাড়িতে’ ভিড় হালকা হতে শুরু করে।
- আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘কটূক্তি’, বেকায়দায় মেয়র জাহাঙ্গীর
- আরও পড়ুন: মেয়র জাহাঙ্গীর আর আওয়ামী লীগের নেতা নন
দল যেদিন এমন সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সন্ধ্যাতেই জাহাঙ্গীরের মেয়র পদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আলোচনা তৈরি হয়। ছয় দিনের মাথায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসে; জাহাঙ্গীর হারান মেয়র পদও।
সিদ্ধান্তটি আসে বিকেল নাগাদ। তখন মেয়র ছিলেন তার বাসাতেই। তিনি কয়েক দিন ধরেই নগর ভবনে যাচ্ছিলেন না। নগর কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা ফাইল নিয়ে তার বাসায় আসতেন, সেখানেই তিনি সই বা সিদ্ধান্ত দিতেন।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাও টুকটাক কিছু মানুষ ‘মেয়র বাড়িতে’ এসেছেন, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসার পর সেই মানুষদের সংখ্যা একেবারেই তলানিতে নামে।
স্বাভাবিক এক বিকেলে গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে এই নীরবতা কদিন আগেও ছিল অভাবনীয়কিছুদিন আগেও যে বাড়িতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের উপচে পড়া ভিড়, থাকত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এভাবেই সেই বাড়িতে নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা।
জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, বহিষ্কারের খবরের পর থেকে মেয়র তার বাড়ির তৃতীয় তলার শোয়ার কক্ষে ভেতর থেকে সিটকিনি আটকে একা ছিলেন। পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেননি কয়েক ঘণ্টা। পরে রাত ৯টার দিকে বের হয়ে ঢাকার দিকে এসেছেন।
বিকেল ৫টায় সরেজমিনে জাহাঙ্গীর আলমের বাসভবনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে দুই-তিনটি মোটরসাইকেল ও গাড়ি পার্কিং করা। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সিঁড়ির কোণে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে বসে থাকতে দেখা যায়।
বাড়ির নিচতলায় জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের অফিস রুমের ভেতরে ৪-৫ জন ব্যক্তি অলস সময় পার করছেন। তাদের প্রত্যেকের চোখ ছলছল করছিল।
সাংবাদিক পরিচয় পেতেই একজন বলে উঠলেন, ‘এখন আর কী বাকি আছে? কী দেখার জন্য আসছেন? সব তো শেষ হয়ে গেছে।’
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ‘কটূক্তির’ রেকর্ড ফাঁসের পরও অনুসারীরা জাহাঙ্গীরকে জড়িয়েই ছিলেন। তবে দল তাকে ছেঁটে ফেলার পর সরে যান ধীরে ধীরেবাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, একটি গোডাউন থেকে দুটি পিকআপ ভ্যানে করে সিটি করপোরেশনের কাজে ব্যবহৃত ফগার মেশিন ও অন্যান্য মালামাল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
কারণ জানতে চাইলে পিকআপ চালক বলেন, ‘মেয়রের বাসা থেকে সিটি করপোরেশনের সব জিনিসপত্র নগর ভবনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
সন্ধ্যার পর মেয়রের বাসভবনে আসেন জাহাঙ্গীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ৩৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মনিরুজ্জামান মনির, ৩৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম ও গাজীপুর মহানগর শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের সভাপতি হেলাল উদ্দিন হেলাল।
তবে কাউকে দেখা দেননি জাহাঙ্গীর। তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।
জাহাঙ্গীর যে বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন, সে বিষয়টি বোঝা গিয়েছিল সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহেই, যখন দলের অনুসারীরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামেন।সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাহাঙ্গীর আলমের বাসভবনে আসেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু টঙ্গী পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী এম এম হেলাল উদ্দিন, গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী মইনুল হোসেন মোল্লা মঈন, ছাত্রলীগ নেতা আল রিয়াদ আদনান অন্তর।
তারা সবাই মেয়রের বাসভবনের তৃতীয় তলার ড্রইংরুমে বসে ছিলেন। রাত ৯টার দিকে জাহাঙ্গীর আলম তার ব্যক্তিগত গাড়িযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। তার সঙ্গে কথা বলতে অপেক্ষায় থাকা নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল কি না, তা জানা হয়নি।
বহিষ্কারের আদেশ আসার পর জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইল ফোনে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে ১৯ নভেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়ার আগে গাজীপুর আওয়ামী লীগের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদককে ফোনে পাওয়া তেমন কোনো ঘটনাই ছিল না। তিনি ফোন ধরতেন, কখনও কখনও ব্যাকও করতেন।