একটি উড়োজাহাজ আকাশে ওড়াতে যে খরচ হয়, তার ৪০ ভাগই মূলত ব্যয় হয় জ্বালানির পেছনে। তাই জ্বালানির দাম ওঠা-নামা করলে তার প্রভাব পড়ে ফ্লাইটের খরচে। শেষ পর্যন্ত এই খরচের বোঝা চাপে যাত্রীদের ঘাড়ে।
বাংলাদেশ উড়োজাহাজের জ্বালানি নিজে উৎপাদন করে না। দেশের প্রয়োজন মেটাতে এই জ্বালানি আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আর এটি এয়ারলাইনসগুলোর কাছে সরবরাহ করে পদ্মা অয়েল লিমিটেড।
গত এক বছর ধরেই দেশে উড়োজাহাজের জ্বালানি, এভিয়েশন ফুয়েল বা জেট ফুয়েলের দাম ঊর্ধ্বগামী। এ সময়ে এই জ্বালানির দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ৩১ টাকা, মূল্য বৃদ্ধির হার ৬৭ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মাসেও বাড়বে জেট ফুয়েলের দাম।
পদ্মা অয়েল লিমিটেডের তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবরে জেট ফুয়েলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ৪৬ টাকা। ডিসেম্বরে ২ টাকা বাড়িয়ে এটি হয় ৪৮ টাকা। আবার এ বছরের জানুয়ারিতে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল ৫৩ টাকায় সরবরাহ করেছে পদ্মা অয়েল। ফেব্রুয়ারিতে দাম ছিল ৫৫ টাকা, মার্চে ৬০ টাকা এবং এপ্রিলে ৬১ টাকা।
মে মাসে এক টাকা কমে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল সরবরাহ করা হয়েছে ৬০ টাকায়। জুনে আবারও দাম বেড়ে হয় ৬৩ টাকা, জুলাই মাসে ৬৬ টাকা, আগস্ট মাসে ৬৭ টাকা এবং অক্টোবরে দাম হয় ৭০ টাকা। নভেম্বর মাস থেকে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল ৭৭ টাকায় এয়ারলাইনসগুলোকে সরবরাহ করছে পদ্মা অয়েল।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জেট ফুয়েলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের বাজারেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে উড়োজাহাজের এ জ্বালানি।
তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জেট ফুয়েলের দাম বাড়াই বা কমাই। এর জন্য আমরা যেটা করি, কলকাতা, মুম্বাই, ইয়াংগুনসহ আমাদের নির্ধারিত আটটি বিমানবন্দর রয়েছে। সে বিমানবন্দরগুলোর কোনটাতে কী দামে জেট ফুয়েল বিক্রি হচ্ছে, তার একটি গড় করা হয়।
‘এরপর আমরা দেখি কলকাতা বিমানবন্দরে কী দামে জেট ফুয়েল বিক্রি হচ্ছে। আমাদের চেষ্টা থাকে সেখানকার চেয়ে আমাদের এখানে যাতে দাম কম থাকে এবং আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী উড়োজাহাজগুলো যাতে কলকাতায় রিফুয়েলিং না করে ঢাকায় রিফুয়েলিং করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আগে কলকাতার চেয়ে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম এখানে ২ সেন্ট করে কম রাখতাম। এখন সেটা ৮ থেকে ১০ সেন্ট কম রাখা হয়।
‘আমাদের চেষ্টা থাকে, এটি আমদানি করতে আমাদের যে খরচ হয়, সরবরাহ করার পরে যাতে আমাদের লোকসান না হয়। আন্তর্জাতিক বাজার যেহেতু এখন চড়া, তাই আমাদের এখানেও দাম বেশি। আগামীতে যদি দাম কমে যায়, আমরাও দাম কমিয়ে রাখব।’
ইন্ডিয়ান অয়েলের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য বলছে, ভারতের কলকাতায় প্রতি লিটার জেট ফুয়েল বিক্রি হচ্ছে ৯৯ টাকায়, মুম্বাইয়ে ৯৩ টাকা এবং দিল্লি বিমানবন্দরে ৯৫ টাকায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশি এয়ারলাইনসগুলোর মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই উৎপাদন করা হয় বেশির ভাগ জেট ফুয়েল। এ কারণে এমিরেটস, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারলাইনসের মতো বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো জেট ফুয়েলের দামের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে দেশে সরবরাহ করা জেট ফুয়েলের দামের পার্থক্যের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশি এয়ারলাইনসগুলো।
কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম ৫০ সেন্ট বা প্রায় ৪২ টাকা।
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এ টি এম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একটি আবেদন থাকবে এটি যেন আর না বাড়ে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো সমস্যায় পড়বে, কারণ যারা প্রতিযোগী তারা বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের যে ক্যারিয়ারগুলো আছে, তারা তো তেলের দাম নিয়ে খুব একটা বদার করে না। তাই বিমান বা ইউএস বাংলাসহ আমাদের যে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো আছে, তাদের অসম একটি প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে।
‘আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের ক্ষেত্রে যেটা হবে, জ্বালানির দামের সাথে ফ্লাইটের খরচও বেড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এটি যাত্রীদের কাঁধেই পড়বে, এটাই হলো সমস্যা। এরপর টিকে থাকাটাই দেশি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য সমস্যা হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যখন প্রভাব পড়বে, দেখা যাবে যে একই গন্তব্যের দুটি ফ্লাইটের টিকিটের দাম দুই রকম।’