টেকো মাথার পুরুষকে নিয়ে অহরহ হাসিঠাট্টায় মাতেন নারীরা। অনেকেই গর্ব করেন নিজের দীঘল চুল নিয়ে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, চুল নিয়ে নারীদের এত বেশি আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। নারীরাও একটি বয়স পেরিয়ে প্রচুর চুল হারাতে থাকেন, আর অনেকেই সেটি আড়াল করেন কৌশলে।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেস অনুষদের অধ্যাপক রোড সিনক্লেয়ার দীর্ঘদিন মাথার কেশ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন, বাস্তবে পুরুষের মতো নারীরও মাথাভর্তি চুল আজীবন থাকে না। পুরুষের টাক অহরহ হয়তো আমাদের চোখে পড়ে, তবে নারীও মধ্য বয়সের পর কেশহীন হতে থাকেন।
‘তফাতটি হলো, চুল হারানো পুরুষের টাক দৃশ্যমান, আর নারীর মাথাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে ফিনফিনে কিছু চুল, যা গোপন করা হয় বিভিন্ন কৌশলে।’
এমনটি কেন ঘটে- সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক আগেই খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় দুই দশক আগে ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের সাইকোলজি বিভাগের একদল গবেষক মানবকোষের এক্স ক্রোমোজমে অ্যান্ড্রোজেন হরমোনগ্রাহী বিশেষ এক ধরনের জিন আবিষ্কার করেন।
অ্যান্ড্রোজেন হরমোন মূলত ‘পুরুষ হরমোন’ হিসেবে পরিচিত, যা পুরুষের বৈশিষ্ট্য এবং প্রজনন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এই হরমোনের মাত্রা পুরুষের দেহে বেশি থাকলেও নারীর শরীরেও এর উপস্থিতি রয়েছে। অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হলো টেস্টোস্টেরন এবং অ্যান্ড্রোস্টেনিডিওন।
আর ক্রোমোজম হচ্ছে বংশগতির প্রধান উপাদান। পুরুষের দেহকোষে এক্স এবং ওয়াই ক্রোমোজম থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে জোড় সংখ্যায় কেবল এক্স ক্রোমোজম রয়েছে। নারীর এই দুটি এক্স ক্রোমোজমের একটি আসে মায়ের কাছ থেকে, অন্যটি বাবার।
গবেষকেরা বলছেন, পুরুষের দেহের এক্স ক্রোমোজমের বিশেষ ওই জিনটি বেশি মাত্রায় টেস্টোস্টেরন হরমোন গ্রহণ করে। এ কারণেই টেকো মাথা পুরুষের সংখ্যা অগণিত। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে এক্স ক্রোমোজমের দুটিতেই ওই জিনটি সমান সক্রিয় থাকে না। বাবার কাছ থেকে পাওয়া এক্স ক্রোমোজমের জিনটি নিষ্ক্রিয় থাকলে মাথার চুল পড়ে কম, তবে মায়েরটি নিষ্ক্রিয় হলে বয়স বাড়লে চুল পড়ার মাত্রা হয় অনিয়ন্ত্রিত।
অধ্যাপক সিনক্লেয়ার বলছেন, এক্স ক্রোমোজমের বিশেষ ওই জিনটির কারণে পুরুষের টাক মাথার সঙ্গে তার শারীরিক আকর্ষণ ক্ষমতার কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “অপরিণত বয়সে চুল পড়ে যাওয়া পুরুষের যৌন ক্ষমতার ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলে না, তবে এ ঘটনা ‘কিছু পুরুষের’ যৌন আবেদন কমায়।”
তিনি বলেন, “আমি এখানে ‘কিছু পুরুষ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করছি, কারণ এতে এ ধরনের সমস্যায় ভোগা সব পুরুষ হয়তো আহত হবেন না।”
চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না বেশির ভাগ পুরুষ
চুল পড়ার সঙ্গে নারীর প্রজনন সক্ষমতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিনক্লেয়ার বলছেন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে চুল পড়ার প্রবণতা সাধারণত মেনোপজের সময় বা পরে দেখা যায়। একে তাদের উর্বরতা হ্রাসের সংকেত হিসেবে দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরলের উচ্চ ঝুঁকির সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়।’
চুল পড়া ঠেকাতে ‘ব্যর্থ পুরুষ’ শেষ পর্যন্ত নিজের টাক নিয়ে আর খুব একটা গা করেন না। তবে ফিনফিনে চুল নিয়ে নারীর অস্বস্তির কোনো শেষ নেই- এমনটিই মনে করছেন অধ্যাপক সিনক্লেয়ার। তার দাবি, পাতলা চুল গোপন করতে ছলের আশ্রয় নেন বেশির ভাগ নারী।
প্রমাণ হিসেবে তিনি অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ‘আপনি যদি এখানে নারীর কেশসজ্জাকারীদের তাদের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, তাহলে দুটি উত্তর পাবেন। তারা বলবেন, কর্মঘণ্টার অর্ধেক সময় ব্যয় হয় চুল কাটার জন্য, আর বাকিটা সময় কাটে বয়স্ক নারীদের পাতলা চুল পুরো মাথায় বিছিয়ে দেয়ার কাজ করে। বয়স্ক নারীরা আসলে এই কাজটি করেন তাদের চুল হারানোর বিষয়টিকে লুকিয়ে রাখতে।’
পার্লারে চুল সাজিয়ে আসার পর এই নারীরা পরের সাত দিন আর চুলে হাত দেন না- এমনটিও দাবি করছেন অধ্যাপক সিনক্লেয়ার। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহ কেটে গেলে তারা আবার পার্লারে যান চুল সাজাতে।
‘অস্ট্রেলিয়ায় সব মিলিয়ে ৭০ হাজার হেয়ার ড্রেসার আছেন, তাদের অর্ধেক সময় নারীদের মাথার চুল সাজাতে ব্যয় হলে আমরা বলতেই পারি, নারীর মাথায় ঝুঁটি বাঁধার যুদ্ধ প্রতিদিন চালিয়ে যাচ্ছেন ৩৫ হাজার সৈনিক।’
এই চুল বিশেষজ্ঞের চূড়ান্ত মত, ‘নারীরা টেকো হচ্ছেন না- এমনটি সত্যি নয়, এর চেয়েও বড় সত্যি হলো, ঘটনাটিকে লুকিয়ে রাখতে চলছে নীরব জালিয়াতি।’