নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রডের দাম। প্রতিদিনই হু হু করে দাম বাড়ছে নির্মাণ শিল্পের অন্যতম এই উপকরণটির। লাগামহীন দামের কারণে রডের গায়ে হাতই দেয়া যায় না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৭৫ হাজার টাকা। সোমবার সেই রডের দাম বেড়ে ৮০ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে।
পাঁচ মাস আগে প্রতি টন রড বিক্রয় হতো ৫৫ হাজার টাকা। ফলে এই সময়ে টন প্রতি দাম বেড়েছে ২৫ হাজার টাকা। শতকরা হারে সাড়ে ৩২ শতাংশ।
মিল মালিকরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের (পুরনো লোহালক্কড়) দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশীয় বাজারে এর দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সহসাই রডের দাম টন প্রতি এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সরকারের চলমান উন্নয়নকাজ তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আবাসন শিল্প গভীর সংকটের মুখে।
আবাসন খাতের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রডের পেছনে। সে জন্য রডের দাম বাড়লে এই শিল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মিল মালিকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি উন্নয়ন কাজে ব্যবহার হয় ৬০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বেসরকারি খাতে।
রডের প্রধান কাঁচামাল পুরানো লোহালক্কড় বা স্ক্র্যাপ আমদানি করে তা রি-রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়।
দেশে রি-রোলিং মিলের সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি। এর মধ্যে বড় আকারের ৫০টি। বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি।
দেশে রডের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে পাঁচটি কারণকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এগুলো হলো আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়া, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ডলার দাম বৃদ্ধি এবং করোনা-পরবর্তী সারা বিশ্বে রডের চাহিদা বেড়ে যাওয়া।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ স্টিল মিলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাসুদুল আলম মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহা, যা স্ক্র্যাপ নামে পরিচিত। এই স্ক্র্যাপ আমদানি করে আমরা কারখানায় বিলেট তৈরি করে রড উৎপাদন করি।’
তিনি আরও জানান, আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৩৩০ ইউএস ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫০০ থেকে ৫৭০ ডলার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে রডের চাহিদা কম থাকে। শীতকালে চাহিদা বাড়ে। নভেম্বর থেকে শীতকাল শুরু হয়েছে। এই সময় সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে নির্মাণ কাজের চাপ থাকে। ফলে সামনের দিনগুলোতে রডের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রডের দাম সহনীয় করতে এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় কী, জানতে চাইলে মাসুদুল আলম বলেন, ট্যারিফ কমাতে হবে এবং ঠিকদারদের চুক্তি সংশোধন করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে রডের প্রতি টন কাঁচামাল আমদানিতে নির্ধারিত ট্যারিফ প্রতি টনে দেড় হাজার টাকা। এর বাইরে উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি টন রডে ২ হাজার টাকা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আরোপ রয়েছে।
মাসুদুল আলম বলেন, সরকার আমদানি পর্যায়ে নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্য কমিয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ এবং উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ২ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা আরোপ করতে পারে।
প্রস্তাবিত করকাঠামো কার্যকর করলে দেশের বাজারে রডের দাম টন প্রতি ৬০ হাজার টাকায় নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঠিকাদাররা বলছেন, তারা যে দামে কাজের আদেশ পেয়েছিলেন, তাতে তাদের পোষাচ্ছে না। কারণ, রডের দাম বাড়ায় তাদের লোকসান হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা সরকারের কাছে কার্যাদেশ সংশোধনের দাবি করছেন। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত তাদের দাবি গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল হক তালুকদার বলেন, নির্মাণ খাত হচ্ছে বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহত্তম শিল্প। বর্তমানে জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১০ শতাংশের বেশি। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
সম্প্রতি দেশের বাজারে রডের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নয়নকাজের গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দাম না কমলে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
রডের দাম কমাতে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে বিএসিআই। এগুলো হলো: সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী দাম সমন্বয়ের ব্যবস্থা চালু করা, সরকারি কাজের মূল্য সমন্বয় করা, সব ধরনের শুল্ক-কর কমানো, সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে দ্রুত শুল্কবিহীন রড আমদানির উদ্যোগ নেয়া ও বর্তমান বাজারদরের ভিত্তিতে গণপূর্তের কাজের মূল্য হালনাগাদ করা।