‘আমরা যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন তিনি শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন। আমাদেরও বিভিন্ন সময় শিবিরে যুক্ত হওয়ার দাওয়াত দিতেন তিনি’- ইকবাল হোসেন ইমাদ সম্পর্কে এ কথা বলেছেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংবাদকর্মী।
উপজেলার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আবুল কাসেম। তিনি বলেন, ‘ইমাদ শিবিরের উপজেলা শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। এ কথা উপজেলার সবাই জানে। তার বাবাও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
ইমাদ এখন কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। শিবিরের সাবেক নেতা হওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে নৌকা প্রতীক দেয়া নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
তবে ইকবাল হোসেন ইমাদ দাবি করে আসছেন, তিনি নন; আরেক ইকবাল হোসেন উপজেলা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় নামের মিলের সুযোগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলন করে গত ১১ অক্টোবর এ বক্তব্য দিয়েছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী ইমাদ।
তবে এসএসসি ও দাখিল উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিতে ২০০৯ ও ২০১০ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখা যে পুস্তিকা বের করেছে, সেখানে ইমাদের নাম আছে। বইয়ে শিবিরের উপজেলা সেক্রেটারির তালিকা দেয়া আছে। তাতে দেখা যায়, ২০০৭ সালে তিনি এই উপজেলা শিবিরের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন।
শিবিরের একটি প্রকাশনায় সদস্যের তালিকায় ইকবাল হোসেন ইমাদের নাম পাওয়া গেছে
২০১৮ সালেও ইমাদ শিবিরকে ৫০০ টাকা ইয়াতন বা চাঁদা দিয়েছেন। সেই চাঁদার রসিদও পেয়েছে নিউজবাংলা।
এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে ২০১৭ সালের দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়ন জামায়াতের একটি অনুষ্ঠানের ছবি। তাতে জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে ইকবাল হোসেন ইমাদকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী হয়ে যাওয়া ইমাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই সবকিছু আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। একটি মহল আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। আমি কখনও শিবির করিনি। আমার আর কিছু বলার নেই।’
তবে ইমাদের কোম্পানীগঞ্জ শিবিরের সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন ২০০৭ সালে উপজেলায় ছাত্র সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বে থাকা শফিকুর রহমান।
বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় থাকা শফিকুর বলেন, ‘আমি সভাপতি থাকাকালে ইমাদ সেক্রেটারি ছিলেন। এখন তিনি কেন অস্বীকার করছেন তা জানি না।’
২০১৮ সালে শিবিরকে চাঁদা দেয়ার রসিদে মিলেছে ইকবাল হোসেন ইমাদের নাম
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইকবাল হোসেন নামে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শিবিরের সেক্রেটারি পদে একজন ছিলেন। তার পুরো নাম ইকবাল হোসেন এমাদ।
উপজেলার বর্ণি এলাকার আব্দুন নূরের ছেলে ইকবাল হোসেন এমাদ ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিবিরের ওই পদে ছিলেন।
সে সময় সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন মো. সালাউদ্দিন। এরপর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন এমাদ। এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।
আর চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলার খাগাইল গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে ইকবাল হোসেন ইমাদ উপজেলা শিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন ২০০৬ সালে। সে সময়ে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আব্দুস শাকুর।
ইমাদের বাবা আব্দুস সালাম কৃষিকাজ করতেন। তিনি জামায়াতের সমর্থক বলে এলাকায় চাউর আছে। তবে তিনি কোনো পদে ছিলেন কি না, তা জানা যায়নি।
দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়ন জামায়াত নেতাদের সঙ্গে ২০১৭ সালের একটি অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখা গেছে ইকবাল হোসেন ইমাদকে
শিবিরের দায়িত্ব ছাড়ার পরই যুক্তরাজ্যে চলে যান ইমাদ। যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নানা বয়সের অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে ইকবাল হোসেন ইমাদের জামায়াত সম্পৃক্ততার এসব তথ্য জানা গেছে। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর নিজের অতীত রাজনৈতিক পরিচয় গোপনে ‘এমাদ’কে সামনে আনার চেষ্টা করছেন ইমাদ- এমন অভিযোগ করেছেন তারা।
এ নিয়ে বুধবার নিউজবাংলার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় ইকবাল হোসেন এমাদের।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে অসুস্থ। গত দুই দিনে এই বিষয়ে আরও কয়েকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমি খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি।
‘প্রায় আড়াই বছর আমি শিবিরের উপজেলা সেক্রেটারি ছিলাম। এরপর মূল সংগঠনে যুক্ত হই। তবে এখন আমি চাকরি করছি।’
উপজেলা শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি ইকবাল হোসেন এমাদ
চেয়ারম্যান প্রার্থী ইকবাল হোসেন ইমাদকে চেনেন না জানিয়ে এমাদ বলেন, ‘তিনি শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না, তা আমার জানা নেই।’
যেভাবে আওয়ামী লীগে ইমাদ
শিবিরের দায়িত্ব ছাড়ার পর ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান ইকবাল হোসেন ইমাদ। সেখানে ম্যানচেস্টার আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতির প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন তিনি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, ওই আওয়ামী লীগের নেতার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময়েই এই দলের দিকে ঘেঁষতে শুরু করেন ইমাদ। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে। যুক্তরাজ্যে থাকা অবস্থায় বিপুল সম্পদও আহরণ করেন তিনি।
এরপর দেশে এসে ইটভাটার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ব্যবসায় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লে ২০১৮ সালের দিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হতে শুরু করেন ইমাদ।
এ সময় থেকে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আর্থিক সহায়তা করতে শুরু করেন তিনি। দলের নেতারাও তার আর্থিক আনুকূল্য নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্য করা হয় ইমাদকে। আর এবার একেবারে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে গেছেন তিনি।
উপজেলা জামায়াতের ত্রান বিতরণের সময় তোলা এই ছবিতেও আছেন ইকবাল হোসেন ইমাদ। ছবিটি ২০১৭ সালের।
চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী ঠিক করতে উপজেলা আওয়ামী লীগের বাছাই কমিটির সভায় তৃণমূলের ২০টি ভোটের মধ্যে ১১টিই পেয়েছেন ইমাদ।
দলে ঢুকেই নেতাদের এতসংখ্যক ভোট পেয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সত্ত্বেও ইমাদকে নৌকা প্রতীক তুলে দেয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ইকবাল হোসেন ইমাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন আমি আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদ পাই, তখন কেউ এসব কথা বলেনি। এখন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমি কেন, আমার পরিবারের কেউই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে কোনো দিনও যুক্ত ছিলেন না।’
ইমাদ সম্পর্কে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফতাব আলী কালা মিয়া বলেন, ‘সে এখন অনেক বড় আওয়ামী লীগার। আমরা তো মনোনয়ন দিই না। আপনার আমার কথায় তো তার মনোনয়ন চলে যাবে না। তাকে দল মনোনয়ন দিয়েছে। সুতরাং সে অনেক বড় আওয়ামী লীগার।’
ইকবাল ইমাদের নামের একটি আইডি থেকে করা পোস্টের এই স্ক্রিনশটগুলো ছড়িয়েছে ফেসবুকে
তবে ইমাদের বিরুদ্ধে শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সত্ত্বেও ইমাদের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে এর আগে নিউজবাংলাকে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেছিলেন, ‘ওই উপজেলায় একসময় আওয়ামী লীগ খুবই দুর্বল ছিল। বিভিন্ন দল থেকে লোকজন এনে সংগঠনকে শক্তিশালী করা হয়েছে। তা ছাড়া প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের প্রতি নিবেদনের পাশাপাশি তার জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়।’