দেশের শিল্প খাতে বছরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ দক্ষ কর্মী প্রয়োজন, কিন্তু সে পরিমাণ দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। ৩৬ শতাংশ নিয়োগদাতাই ভুগছেন দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কর্মী সংকটে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) এক সেমিনারে সোমবার এ তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাল্টিপারপাস হলে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইনক্লুসিভ গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এনএসডিএ নির্বাহী চেয়ারম্যান দুলাল কৃষ্ণ সাহা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশের অর্থনীতি ক্রমে কৃষিনির্ভর থেকে শিল্পনির্ভর হচ্ছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটি) দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে চায়।
তিনি জানান, বর্তমানে বছরে দেশে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে সামান্য অংশই দক্ষ রয়েছে। বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পতে সাড়ে ১৮ লাখ এবং বিদেশের শ্রমবাজারে ৫ লাখ দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে।
পারভেজ বলেন, দেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মানুষের মধ্যে ৮২ শতাংশই কর্মে নিয়োজিত। তবে তাদের মধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশ প্রফেশনালস (কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা) রয়েছে। ৫৩ শতাংশ টেকনিক্যালি মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০.৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করতে চায়। তবে তার জন্য প্রায় ৮০ লাখ দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন, যা বর্তমানে ২৬ লাখের মতো রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই কর্মক্ষম। যদিও বেকারত্বের হার ১২.৩ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটিতে। এ বিপুল যুব জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদার উপযোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিভিন্ন পলিসি প্রণয়নে সরকারকে সহযোগিতার জন্য ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সহজতর হবে। করোনার অস্বাভাবিক এ সময়ে পেশার ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। করোনাকালীন মানুষ ব্যাপকভাবে ডিজিটাল প্লাটফর্ম-নির্ভর হয়েছে। ফ্রি-ল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সামাজিক ও পেশাগত পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে প্রচলিত প্রশিক্ষণ কোর্সের কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক ও আগামীর প্রযুক্তির চিন্তা মাথায় রেখে স্ট্যান্ডার্ড ও প্রশিক্ষণ কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে অনেকে চিন্তিত। তবে মেশিন কখনও মানুষকে রিপ্লেস করবে না। এ জন্য অপনাকে ওই বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে, দক্ষ হতে হবে।’
বর্তমানে প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে প্রায় ২২ লাখ যুবক যুক্ত হচ্ছে জানিয়ে মুখ্য আলোচক অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগানোর এখনই প্রকৃত সময়। কর্মক্ষম জনবলকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে একদিকে উৎপাদনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে দক্ষ জনবল বিদেশে প্রেরণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে দুলাল কৃষ্ণ সাহার মতে, দেশের দক্ষতা উন্নয়নের চিত্রটি খুব আশাপ্রদ নয়। এর কারণ শিল্প খাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ হয়নি। এটা কাগজে-কলমেই রয়েছে। এখনও ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে দেয়া হয় না।
তিনি বলেন, ‘শ্রমশক্তির ৮৫.১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯.৯ শতাংশ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অন্যদিকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২৯.৮ শতাংশ কোনো ধরনের শিক্ষা, শ্রম বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। এই বিপুল স্বল্পশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষকে দক্ষ করে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষকেরও সংকট রয়েছে।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ সায়েম বলেন, ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন। কোন সেক্টর গ্রোথ সেক্টর, কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন, তা আগে নিরূপণ করতে হবে। সে অনুযায়ী কারিকুলাম ডেভেলপ করতে হবে।