‘হুজুর দেইখ্যা কম টাকায় বাসা ভাড়া দিছি। হেই হুজুর নাকি; বউরে কেরোসিন ঢাইলা পুইড়া মারতে চাইছিল। হুজুর সাব বউয়ের গায়ে আগুন দিয়া ঘরে তালা মারছে। পরে পালাই গেছে।'
কথাগুলো বলছিলেন গভীর রাতে সাউন্ডবক্সে উচ্চস্বরে ওয়াজ বাজিয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন ও পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে যে বাড়িতে, সেই বাড়ির মালিক রেজাউল হক।
তিনি জানান, শনিবার রাত ৩টার দিকে শ্রীপুর উপজেলার নতুনবাজারের আনছার রোড এলাকার বয়রাসালায় তার ভাড়াটিয়া মাওলানা শরিফ মাহমুদ তার স্ত্রী খুশি আকতারের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর ঘরে তালা দিয়ে বাইরে অবস্থান করে। পরে অন্য ভাড়াটিয়ারা তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে খবর দেন।
তিনি বলেন, 'স্থানীয় মাতাব্বর নিজাম উদ্দিনের কথায় হুজুরকে বাসা ভাড়া দিছি। হুজুর দুই মাস হলো এখানে থাকে; তার এক মাসের ভাড়া বাকি এখনও।'
ইমামের যে চরিত্র দেখেছেন, তাতে অবাক হয়েছেন রেজাউল হক। বলেন, ‘হুজুর সাবরে ভালা মানুষ ভাবছিলাম, কিন্তু সে তো ভালা না। শুনতেছি হুজুর পরকীয়া করে। বউ পিটায়। ভাবতেই পারছি না। তারে বাসা থাইক্যা তাড়াই দিছি।'
রেজাউলের বাসায় পাশের রুমের ভাড়াটিয়া গার্মেন্টসকর্মী কল্পনা রানী সরকার বলেন, ‘রাতে আগুন আগুন চিৎকার হুইনা গেছি। যাইয়া দেহি পানি ঢালতাছে খুশির গায়। তহন হুজুর সাব দরজায় দাঁড়ায় আছিল। এরপর দেহি হুজুর ভাগছে।'
গত ১৮ সেপ্টেম্বর যৌতুক না পেয়ে গভীর রাতে উচ্চস্বরে সাউন্ডবক্সে ওয়াজ বাজিয়ে নির্যাতনের পর খুশি আকতার নামে ওই গৃহবধূর শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে স্বামী মাওলানা শরিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বুধবার রাতে শ্রীপুর থানায় মেয়েটির বাবা হাসেন আলী লিখিত অভিযোগ করেন।
নির্যাতনের শিকার খুশি আকতারের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের বদলাগাড়ি গ্রামে।
খুশির পরিবার জানায়, পারিবারিকভাবে ২০১৯ সালের ১২ জুন গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় এলাকায় মাওলানা শরিফ মাহমুদের সাথে বিয়ে হয় খুশির। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীপুরে যান শরিফ। সেখানে স্থানীয় ইয়াকুব আলী জামে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন তিনি।
খুশির স্বজনদের অভিযোগ, আর্থিক দৈন্যদশা ও বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে শরিফ কিছুদিন ধরে স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিল। গত শনিবার রাতে স্ত্রীর কাছে এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন শরিফ। এ সময় টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের কথা তোলায় মারপিট শুরু করেন শরিফ।
এরপর রাত ৩টার দিকে উচ্চস্বরে সাউন্ডবক্সে ওয়াজ বাজিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে খুশির চিৎকারে পাশের রুমের এক নারী এসে প্রতিবেশিদের সহায়তায় খুশিকে উদ্ধার করে।
ঘটনার রাতে মোবাইলে খবর পেয়ে গাইবান্ধা থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান তিনি। মেয়েটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছে, আগুনে খুশির শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রায় ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তবে বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত।
মেয়েটির বাবা হাসেন আলীর অভিযোগ, যৌতুকের জন্য তার মেয়ে খুশিকে প্রায় মারধর করতেন শরিফ। সম্প্রতি শরিফ বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ালে নির্যাতন আরও বাড়ে। প্রায়ই খুশিকে মোমবাতির আগুনে হাত-পায়ে ছ্যাঁকা দেয়া হতো।
তিনি বলেন, 'যে মারডা মারছে ছোলটাক। বাপ হয়ে সহ্য করতি পারি না। আল্লায় বাঁচাইছে ছোলটাক। সারা গাওত ফোসকা পড়ছে। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।'
হাসপাতালের বেডে শুয়ে খুশি আকতার বলেন, 'এখনও সেই রাতে কথা মনে হলে কলজাটা ফাটি যাচ্ছে। ওটা (শরিফ) মানুষ নয়; পশু।'
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান এম এ হামিদ পলাশ জানান, খুশির নাভির নিচ থেকে পা পর্যন্ত ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। স্তনের কিছু অংশও পুড়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'আজ রাতে রোগীর প্লাস্টার খোলা হবে। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। সুস্থ হতে সময় লাগবে।'
এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাম হোসেন বলেন, 'প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা মিলেছে। মামলা রেকর্ড করাসহ আসামিকে ধরতে অভিযান চলছে।'