জরাজীর্ণ স্লিপার, জয়েন্টে নেই নাটবল্টু। ক্লিপ-হুকসমেত ফিশপ্লেটও গায়েব।
এমন বেহাল রেলপথ দিয়ে চলছে চট্টগ্রাম, ভৈরব, মোহনগঞ্জ ও জারিয়া-ঝাঞ্জাইলগামী আন্তঃনগরসহ বেশ কিছু লোকাল ট্রেন।
ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত শতবর্ষ প্রাচীন রেলসেতু ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। গুরুত্বপূর্ণ রেলপথের এমন নাজুক অবস্থায় ক্ষুব্ধ এই পথে চলাচলকারী ও স্থানীয় লোকজন। তাদের প্রশ্ন, ঝুঁকিপূর্ণ এই রেলপথের সংস্কার হবে কবে?
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদকসেবীরা টাকার জন্য পুরোনো লাইন থেকে প্রায়ই হুক বোল্ট ও ডকস্পাইক খুলে নেয়। তা ছাড়া পুরোনো কাঠের স্লিপারগুলো পঁচে নষ্ট হয়েছে। লাইনের নিরাপত্তায় দেয়া পাথর এখন নেই বললেই চলে।
সেতুর ৬৬২টি স্লিপারের বেশিরভাগেরই এই হাল। রেলসেতুটিতে রেলিং বা সেইফ গার্ডও নেই।
এলাকার প্রবীণ মাঈদ উদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, সেতুটির অংশবিশেষ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর এটি সংস্কার করলেও তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো সংস্কার হয়নি।
মাসুদুর রহমান নামে এক যুবক বলেন, ‘অনেক নাটবল্টু নেশাগ্রস্তরা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে। স্লিপারগুলো পুরোনো হওয়ায় অনেক দুর্বল হয়েছে। হেলেদুলে ট্রেন চলার সময় মনে হয় ব্রিজ ভেঙে যেকোনো সময় নদীতে পড়ে যাবে।’
ব্রহ্মপুত্র রেলওয়ে সেতুর পাশে শম্ভুগঞ্জ স্টেশনের কাছে ‘কোরেরপাড়’ নামের আরও একটি ছোট সেতু আছে। এই সেতুরও বেশ কিছু নাটবল্টু খোয়া গেছে।
স্থানীয় আব্দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ময়মনসিংহের মূল শহরে প্রবেশ করার জন্য এই সেতুটি আমরা ব্যবহার করি। কাঠের ভাঙাচোরা স্লিপারগুলো পরিবর্তন করা জরুরি৷ কারণ ট্রেন যাওয়ার সময় বেশ কিছু স্লিপার নড়বড় করে। মনে হয় এই বুঝি ট্রেন পড়ে গেল।’
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন উদ্বোধন হয় ১৮৮৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এ জংশন হয়ে ময়মনসিংহ-ঢাকা, ভৈরব, মোহনগঞ্জ, জারিয়া-ঝাঞ্জাইল ও জামালপুরগামী পাঁচটি রেলপথ রয়েছে।
রেলওয়ের ময়মনসিংহ সাব-ডিভিশনের অধীনে ময়মনসিংহ-শ্রীপুর সেকশনে ৯২টি, ময়মনসিংহ-বিদ্যাগঞ্জ সেকশনে ৩২টি, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর এবং গৌরীপুর-আঠারোবাড়ী সেকশনের প্রতিটিতে ২৭টি করে, গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ সেকশনে ৮২টি, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া সেকশনে ২৫টিসহ মোট ২৮৫টি ছোট-বড় রেলসেতু ও কালভার্ট রয়েছে।
এর মধ্যে তিনটি রেলসেতু বড়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরে ৯০০ মিটার দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র রেলওয়ে সেতু, ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথের কাওরাইদ রেলস্টেশন সংলগ্ন সুতিয়া নদীর সেতু এবং ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ রেলপথের ঠাকুরাকোনার বারহাট্টায় কংস নদীর রেলসেতু।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেহাল লাইনের কারণে ময়মনসিংহের রেলপথে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের একটিও চালানো সম্ভব হয়নি। ২০০ হর্স পাওয়ারের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন লোকোমোটিভ ইঞ্জিন অনেক বড় এবং ওজন বেশি হওয়ায় পুরোনো লাইনে ব্যবহার করা যায়নি।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন রুটের লাইনের এক্সেল লোড (ভারবহন ক্ষমতা) ১০ থেকে ১১। তবে নতুন ইঞ্জিনগুলোর এক্সেল লোড ১৫। এসব ইঞ্জিন শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গ রুটে চালানো সম্ভব।
জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘পুরোনো সবগুলো কাঠের স্লিপার জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমরা চাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কর্তৃপক্ষ এগুলো সংস্কার করুক। এ ছাড়া রেললাইনে দেয়া যন্ত্রগুলোর চুরি রোধে কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
স্থানীয় নাগরিক সংগঠন ‘জনউদ্যোগ’ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ‘যতক্ষণ বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে বা প্রাণহানি না ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। আমরা চাই না একটি রেলদুর্ঘটনার কারণে কোনো প্রাণহানি হোক। অতি দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনসহ রেলসেতু সংস্কার করা প্রয়োজন।’
রেলসেতুগুলোর ঝুঁকির কথা স্বীকার করে ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হাসান বলেন, ‘শতবর্ষ পুরোনো হলেও সেতু ভাঙার প্রয়োজন নেই। তবে, স্লিপারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন করতে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই এটির কাজ শুরু হবে।’