গৃহকর্মীদের বেতন কমপক্ষে পোশাককর্মীদের সমপরিমাণ করার সুপারিশ করেছে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। কাজের ধরন ও প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সরকারের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে বলেও জানায় বেসরকারি সংস্থাটি।
গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের নিরাপদ ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বিলসের প্রস্তাবিত আট দফা সুপারিশে উঠে আসে এমন দাবি।
রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি বাস্তবায়ন নিরীক্ষা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন সব সুপারিশ ও দাবি তুলে ধরে বিলস।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতির কথা উল্লেখ করে সংগঠনটি থেকে জানানো হয়, নিয়োগকারীর সঙ্গে ৯৯ শতাংশের বেশি গৃহশ্রমিকের কোনো লিখিত চুক্তি নেই। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই। সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটিরও ব্যবস্থা নেই এবং তাদের পেশাগত কোনো নিশ্চিয়তা নেই।
সংগঠনটি থেকে প্রস্তাব রাখা হয়, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালাকে আইনে রূপান্তর করতে হবে। গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের স্বীকৃতি দিতে হবে। কর্মস্থলে গৃহকর্মীদের সুরক্ষিত থাকার ব্যবস্থা এবং সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন রোধ করতে হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি বাস্তবায়ন নিরীক্ষা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে বিলস। ছবি: নিউজবাংলা
বিলসের আট সুপারিশ
১. গৃহস্থালি কাজকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এ জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের সেলকে আরও সক্রিয় করতে হবে। লিখিত চুক্তিটিকে গৃহকর্মী এবং নিয়োগকারীদের মধ্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিদ্যমান নীতিকে আইনে পরিণত করতে হবে।
২. ইউনিয়ন-থানা পর্যায়ে গৃহশ্রমিক-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এটি গৃহশ্রমিকদের পরিস্থিতি তাদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন বিষয়ে বিশদ পরিসংখ্যান পেতে সরকারকে সহযোগিতা করবে। জাতীয় জরিপে গৃহশ্রমিকদের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
৩. গৃহশ্রমিক এবং নিয়োগকারী উভয়কেই বিভিন্ন সচেতনতা কর্মসূচি এবং উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। হেল্প লাইন নম্বর ব্যবহার করার জ্ঞান এবং গৃহশ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় গৃহশ্রমিকদের জন্য বিধান থাকা দরকার।
৪. গৃহশ্রমিকদের জন্য একটি অভিযোগ কেন্দ্র থাকা উচিত, যাতে তারা হয়রানি বা নির্যাতনের যেকোনো ঘটনার বিরুদ্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে পারে। এ কাজে মহিলা পুলিশ নিয়োগ করা উচিত, যাতে তারা সরাসরি ভুক্তভোগী গৃহশ্রমিকদের জন্য কাজ করতে পারে। ১২-১৪ বছর বয়সী নারী গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত। প্রতিটি ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা দরকার।
৫. গৃহশ্রমিকদের বেতন কমপক্ষে গার্মেন্টস খাতের সমপরিমাণ করতে হবে এবং তাদের উৎসব বোনাস দিতে হবে। গৃহশ্রমিকদের তাদের বেতনের ৫০ শতাংশ বোনাস দিতে হবে। কাজের ধরন-প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সরকারের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগী হিসেবে অভাবী গৃহশ্রমিক পরিবারকে বাছাই করতে হবে। গৃহশ্রমিকদের জন্য এলাকাভিত্তিক আবাসন, হোস্টেল, অ্যাম্বুলেন্স এবং হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহশ্রমিকবান্ধব নীতি নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি, ন্যূনতম মজুরি অধিকার, ডিজিটালাইজড অর্থ লেনদেন বাস্তবায়ন করা দরকার। গর্ভবতী গৃহশ্রমিকদের গর্ভকালীন সময়কালে এবং সন্তান প্রসবের পর কমপক্ষে ৬ মাস সবেতন ছুটি দিতে হবে।
৬. গৃহশ্রমিকদের তাদের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা এবং মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি করার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। গৃহকর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও একই কাজে সহযোগিতা করতে পারে। সরকারের উচিত গৃহশ্রমিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। এ ছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর গৃহশ্রমিকদের যোগ্য মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
৭. গৃহশ্রমিকরা যদি সংগঠিত হতে পারে, তবে তারা সহজেই তাদের উপার্জন এবং তার পরিমাণ নিয়ে কথা বলতে পারবে। সরকারের উচিত গৃহশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমতি দেওয়া; যাতে তারা নিজেরাই তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে পারেন এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের দাবি এবং অবস্থান প্রকাশ করতে পারেন। ট্রেড ইউনিয়ন এবং নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি হতে পারে, যেখানে গৃহশ্রমিকদের অধিকার যেমন মজুরি শোভন কাজের শর্ত এবং অন্যান্য সুবিধার উল্লেখ থাকবে।
৮. কোভিড-১৯-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গৃহশ্রমিকদের মূল্যায়ন বিষয়ে গবেষণা করা উচিত। জিডিপিতে গৃহকর্মীদের অবদান এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি এবং আইন অনুযায়ী সারা দেশে সব গৃহশ্রমিকর অবস্থা বিষয়ে গবেষণা হতে পারে।