বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তারা এখন ‘শত্রু’

  •    
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২১:২৫

ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখন তিক্ত। দলটির শীর্ষ নেতারা তার বক্তব্যে শুধু বিব্রতই বোধ করছেন না, তাকে এড়িয়ে চলছেন। এবার দুই পক্ষ প্রকাশ্য বাকযুদ্ধে জড়াতে শুরু করেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বিএনপি কাছাকাছি এসে জোটের শরিকে পরিণত হলেও সম্প্রতি দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

নানা সময় বিএনপিকে উদ্দেশ করে পত্রিকায় খোলা চিঠি ও নানা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আসা জাফরুল্লাহ যখন নেতৃত্ব থেকে তারেক রহমানকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই দেশের অন্যতম বৃহৎ দলটির সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে।

গত ২৬ জুন জাফরুল্লাহ প্রথমবার তার পরামর্শটি দেয়ার পর থেকে বিএনপির বা দলটির সমর্থক কোনো সংগঠনের আয়োজনে জাফরুল্লাহকে না ডাকতে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। এর মধ্যেও গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে তাকে আমন্ত্রণ করে বসে সংগঠনটি।

এই আয়োজনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে আবার তারেক রহমানকে সরিয়ে তার মেয়ে জাইমা রহমানকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন জাফরুল্লাহ।

২৬ জুনের বক্তব্যের পর জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথমে সোচ্চার হয় ছাত্রদল নেতারা। পরে এতে যোগ দেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নাম উল্লেখ না করে জাফরুল্লাহর কড়া সমালোচনা করেন।

তবে মির্জা ফখরুল এবার রাখঢাক না রেখে বলে বসেন, ‘জাফরুল্লাহর বয়স হয়ে গেছে বলে উল্টাপাল্টা বকেন।’

এমন বক্তব্যের পর জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা বিএনপির জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বিব্রতকর। জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুলকে ‘চাকর-বাকর’ বলে বসেন তিনি।

পরে এক অনুষ্ঠানে জাফরুল্লাহ ক্ষমা চাইলেও তিনি তাতে যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা বিএনপির জন্য আরও বিব্রতকর হয়। তিনি বলেন, ‘আমি চাকর-বাকরের কাছে ক্ষমা চাইছি।’

কেন বিএনপির ওপর অসন্তোষ জাফরুল্লাহর

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা জাফরুল্লাহর ফাঁসি চেয়ে পোস্টার প্রকাশ করেছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের দ্বিতীয় মেয়াদ থেকে বিএনপি ও জাফরুল্লাহ কাছাকাছি আসেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তারের আগে একটি জাতীয় দৈনিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে এক পাতার খোলা চিঠি লেখেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এমন চিঠি পরে তিনি আবার লেখেন।

সাম্প্রতিক উত্তেজনার আগের পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির সঙ্গে জাফরুল্লাহর সম্পর্ক ছিল মধুর

দশম সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের এক বছর পূর্তির দিন ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বেগম খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডাকার পর যখন অকার্যকর কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসতে পারছিলেন না, তখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন সে সুযোগ করে দেয়। অবরোধের সময় বিএনপিকে ভোটে আনতে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের একজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার পেছনেও ভূমিকা রাখেন জাফরুল্লাহ। তিনি নিজেও যোগ দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। তবে নিজে ভোটে অংশ নেননি।

তবে গত বছরের শেষ মাস থেকেই দুই পক্ষে সন্দেহ-অবিশ্বাস শুরু হয়।

গত ৪ ডিসেম্বর মুক্তাঙ্গনে সরকার পতনের দাবিতে হঠাৎ অবস্থান নেয় বিএনপি ও তার জোটের শরিকদের একটি অংশ। তবে এমন কর্মসূচির কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না বিএনপির। তখন যুক্তরাজ্য থেকে তারেক রহমানের কাছ থেকে আসে জরুরি নির্দেশ। মুক্তাঙ্গন থেকে নেতা-কর্মীদের সরে যেতে বলা হয়।

এ ঘটনায় বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। তারা সে নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তবে বিএনপিতে আগের অবস্থান আর ফিরে পাননি।

বিএনপির ধারণা, হঠাৎ এই কর্মসূচির পেছনে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে যে কর্মসূচি শেষ করে নেতা-কর্মীরা মুক্তাঙ্গনে অবস্থান নেন, সেখানে বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাও। তবে তিনি নিজে মুক্তাঙ্গনে যাননি।

গত ৪ ডিসেম্বর সরকার পতনের ডাক দিয়ে মুক্তাঙ্গনে বিএনপির কর্মীদের অবস্থানের পেছনে জাফরুল্লাহর ভূমিকা জানতে পেরে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেয় বিএনপি

এর আগে থেকেই জাফরুল্লাহ বিএনপিকে বারবার আন্দোলনে নামতে তাগাদা দিয়ে এসেছেন, যেমনটি এখনও বারবার বলছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সে সময় নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, জাফরুল্লাহর সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে দলের নেতা-কর্মীদের বলে দেয়া হয়েছিল।

ওই নেতা এমনও জানান, তারেক রহমানের নির্দেশ ছিল জাফরুল্লাহর কোনো পরামর্শ গ্রহণ করা যাবে না।

কেন বিএনপিকে আন্দোলনে নামাতে চান জাফরুল্লাহ?

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এই প্রশ্নে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যা বলেছি, তা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি তাদের পরামর্শ দিয়ে এসেছি, তাদের ভালোর জন্য বলেছি। আর সামনেও বলব।

‘আমি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। তারা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) না করলেও আমি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। ভালো চাইতে গেলে অনেক সময় অপ্রিয় সত্য কথাও বলতে হয়। তাতে তাদের মনে কষ্ট লাগলে আমি দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। তবে তাদের ভালো চাই যেহেতু, এমন তেতো সত্য আমি বরাবরই বলব।’

বয়স নিয়ে তার প্রতি বিএনপির খোঁটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে এটা তো সত্য। তবে আমার তো আলজাইমার হয় নাই। আমি এখনও দূরের সব দেখতে পারি। বিএনপি না করেও বিএনপির অবস্থান বুঝতে পারি।’

জাফরুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়, বিএনপি তো আপনার পরামর্শ নিচ্ছে না। তাও কেন বারবার তাদের উদ্দেশ করে একই ধরনের বক্তব্য রাখছেন?

এর জবাবে বলেন, ‘সে জন্যই আমি চাকর-বাকর বলেও আবার চাকর-বাকরদের কাছেই ক্ষমা চেয়েছি। কারণ চাকর-বাকররাও বিরক্ত হয়ে একসময়ে প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু এই রাজনৈতিক কর্মীরা নড়েচড়েও বসেন না। আমি আমার পরামর্শ জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে দিই। সেটা আমি দেবই।’

তারেককে কেন নেতৃত্ব ছাড়তে হবে?

জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমি কী এমন ভুল বলেছি? তারেক রহমান কি দেশে আছেন? হাওয়াতে বসে থেকে তিনি কী করতে পেরেছেন? তিনি তার মাকে পর্যন্ত বের করতে পারেননি। তাই আমি বলেছি, জাইমাকে দেশে এনে নতুন নেতৃত্ব বানান।’

বিএনপি নেতারা কথা বলতে চান না

জাফরুল্লাহর প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা নিউজবাংলাকে এড়িয়ে গেছেন। তারা বলেছেন, দলের মহাসচিবের প্রতিক্রিয়াই তাদের বক্তব্য।

স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে এগুলো তো কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য না। তাই এ নিয়ে আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া আসলে নেই। তবে আমাদের মহাসচিব তো দিয়েছেন প্রতিক্রিয়া। ব্যাপারটা অমনই, বয়স হয়েছে, কখন কী বলছেন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে না। আবার কেন বলছেন, তাও বোঝা যাচ্ছে না।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘মহাসচিব যা বলার বলেছেন। ওনার বয়সটা ওনার মাথায় রাখা উচিত। ওনার এখন ঘরে বিশ্রাম নেয়ার সময়।’

বাকযুদ্ধের শুরু

বিএনপি ও জাফরুল্লাহর মধ্যকার ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ উত্তেজনায় রূপ নেয় গত ২৬ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক আলোচনায়।

বিএনপিপন্থি একটি সংগঠনের আলোচনায় সেদিন তিনি বলেন, ‘বিএনপির ওহি আসে লন্ডন থেকে। তারেক রহমানের দুই বছর চুপ করে থাকা উচিত। তার যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা উচিত।’

এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্রদলের এক নেতা তাকে থামিয়ে দিয়ে সতর্ক করেন, তিনি (জাফরুল্লাহ) যেন বিএনপি নেতার সমালোচনা না করেন। আর করলে যদি তার কিছু হয়ে যায়, তবে তারা দায়ী থাকবেন না।

তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়ার পর গত ২৬ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনায় জাফরুল্লাহর সঙ্গে তর্কে জড়ান ছাত্রদল নেতা ওমর ফারুক কাউসার

এ ঘটনার পরে বিএনপির অঙ্গসংগঠন থেকে জাফরুল্লাহর সমালোচনা করে বিবৃতি দেয়া হয়। এমনকি স্থায়ী কমিটির এক আলোচনা সভায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও জাফরুল্লাহর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।

পরে জাফরুল্লাহ নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিএনপি গোঁয়ার।’

তারপরে দীর্ঘদিন বিএনপির বা সহযোগী সংগঠনের কোনো আয়োজনে জাফরুল্লাহকে দেখা যায়নি। তবে ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা দলের আলোচনায় মির্জা ফখরুলের উপস্থিতিতে আবারও তারেক রহমানকে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

মির্জা ফখরুল সেদিন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ৬ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে কথা বলেন জাফরুল্লাহ প্রসঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘জাফরুল্লাহ সাহেব যে কথা বলেছেন… তার আসলে বয়স হয়ে গেছে। উনি অত্যন্ত সম্মানিত লোক, অত্যন্ত গুণী লোক, কিন্তু বয়স হয়ে গেলে মানুষ কিছু উল্টাপাল্টা কথা বলতেই পারেন। এটা স্বাভাবিকভাবে বলেছেন আরকি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এতদিন চুপ থাকলেও গত ৬ সেপ্টেম্বর ‘বয়স হওয়ায় উল্টাপাল্টা বকেন’ বক্তব্য দিয়ে জাফরুল্লাহর বিরাগভাজন হয়েছেন

‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে তারেক রহমানকে দায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার (জাফরুল্লাহ) মন্তব্যটা যুক্তিসংগত না। তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, কথা বলছেন। কিন্তু তিনি একবারও ভাবছেন না, এসব কথা বললে ফ্যাসিবাদীবিরোধী আন্দোলন কিছুটা ব্যাহত হবে।’

এরপর জাফরুল্লাহর ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বেচারা বাড়ির চাকর-বাকরের মতো আছে। ভাবছে, চাকরি চলে যাবে৷ তার বক্তব্যে আমার হাসি পেয়েছে।’

গত শুক্রবার শহীদ মিনারে এক আয়োজনে মির্জা ফখরুলদের কাছে ক্ষমা চেয়ে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে আমার স্নেহাস্পদ ব্যক্তিদের চাকর-বাকর হিসেবে তুলনা করায় তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। কষ্ট পেয়েছেন। আমি এসব চাকর-বাকরের কাছে ক্ষমা চাইছি।

‘এসব রাজনৈতিক কর্মীর চাকর-বাকরের গুণাবলিও নেই। তাদের না কবজিতে জোর আছে, না মাথা ঘোরানোর অধিকার আছে। চাকর-বাকর ভাইরা, আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই।’

এ বিভাগের আরো খবর