দেশের পুঁজিবাজারে টানা সাত দিন সূচক বাড়ল, যা সচরাচর দেখা যায় না। স্বল্প মূলধনি বেশ কিছু কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার মধ্যে মৌলভিত্তির বড় মূলধনি কোম্পানিতে আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিও স্পষ্ট হচ্ছে।
দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর নিয়ে হতাশাই ছিল এ খাতের বিনিয়োগকারীদের।
মঙ্গলবার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়ায় দেশীয় মৌলভিত্তির বেশ কিছু কোম্পানিতেও ঝোঁক দেখা দিয়েছিল। সপ্তাহের চতুর্থ কর্মদিবস বুধবারেও এই বিষয়টি দেখা গেল।
আগের দিন ৬৫ পয়েন্টের পর আজ সূচক বাড়ল ৫৫ পয়েন্ট। গত ৩১ আগস্ট উত্থান শুরুর দিন থেকে বাড়ল মোট ৩৭৩ পয়েন্ট।
অথচ এর আগে তিন দিন টানা দরপতনে ৫৯ পয়েন্ট সূচক হারানো নিয়ে বাজারে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল। কারণ টানা তিন দিনের দরপতন গত ৪ এপ্রিলের পর এর আগে হয়নি।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
উদ্বেগ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে স্বল্প মূলধনি, লোকসানি বেশ কিছু কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা তৈরি হয়। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব কোম্পানি নিয়ে করণীয় নির্ধারণে কমিটিও গঠন করে। এই পদক্ষেপে আরও তেতে ওঠে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার দর। ছড়িয়ে পড়ে যে, এসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে হবে। আর বোনাস শেয়ার, রাইট শেয়ারের মাধ্যমে এই মূলধন বাড়ানো হবে আশায় বেশি দামে শেয়ার কিনছেন বিনিয়োগকারীরা।
তবে দুর্বল কোম্পানি শেয়ার বাড়ালেই কী লাভ হবে- এমন আলোচনাও উঠেছে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা তো বটেই, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নিজেও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছেন। বলেছেন, তারা যেন শক্ত মৌলভিত্তির শেয়ারে থাকেন।
এর মধ্যে টানা দ্বিতীয় দিন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোনের দর বাড়ল। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মার দর। এবার যোগ হলো ব্র্যাক ব্যাংক।
বুধবারের সূচক বৃদ্ধিতে প্রধান অবদান এসব কোম্পানিই।
তাই বলে যে পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর দাপট কমে গেছে তা নয়। বরং এদিনও দিনের সবচেয়ে দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিটি ছিল দুর্বল মৌলভিত্তির ও স্বল্প মূলধনি।
সূচক বাড়লেও বিনিয়োগকারীরা যে কিছুটা সতর্ক তা লেনদেনের চিত্রেই স্পষ্ট। সূচক বাড়তে থাকলেও লেনদেন কমছে তিন দিন।
গত ৬ সেপ্টেম্বর লেনদেন ছিল ২ হাজার ৯০১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ৭ সেপ্টেম্বর তা কমে হয় ২ হাজার ৮৬৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আজ আরেকটু কমে লেনদেন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করলে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে ব্যাংক খাতে, যদিও দাম বৃদ্ধির হার খুবই কম। কিছুটা হলেও দর বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বস্তি গেছে মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের শেয়ারধারীরাও হেসেছেন।
অন্যদিকে বিমা খাতের শেয়ারগুলো দর হারিয়েছে। বস্ত্র খাতেও দিনটি ভালো যায়নি। আর্থিক খাতেও পতন হয়েছে বেশির ভাগ কোম্পানির। জ্বালানি খাতের কয়েকটি কোম্পানি বেশ ভালো করলেও দর হারিয়েছে এই খাতের বেশির ভাগ কোম্পানি। একই চিত্র ওষুধ খাতেও।
শীর্ষ ২০ কোম্পানিতে বড় মূলধনির আধিক্য
টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে স্কয়ার ফার্মার মেয়ার। ৯৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ৪১ লাখ ৯ হাজার ৪১৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। শেয়ার দর ২৩৫ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪৩ টাকা।
বৃটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর ৮৭ কোট ৬৪ লাখ টাকার ১৩ লাখ ২১ হাজার ৪৮৮টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। শেয়ার দর ৬৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬০ টাকা ২০ পয়সা।
দীর্ঘদিন পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের খুলনা পাওয়ার কোম্পানি বা কেপিসিএল ছিল তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে। ৭৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকায় ১ কোটি ৫৩ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬১টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৬৬ কোটি টাকার। শেয়ার দর ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৭ টাকা ৩০ পয়সা।
আরেক বড় মূলধনি কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার ৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। হাতবদল হয়েছে ৩০ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৪টি শেয়ার।
এই সব কটি কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে।
দরও বেড়েছে, বিনিয়োগও বেড়েছে ব্যাংকে
একদিনের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের নতুন বিনিয়োগ যোগ হয়েছে ২৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। মঙ্গলবার লেনদেন ছিল ১৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। বুধবার তা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ১৭৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
৩২টি ব্যাংকের মধ্যে দর বেড়েছে ২১টির, কমেছে ২টির আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি ৭টির।
ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে রূপালী ব্যাংকের। ৬.৭৬ শতাংশ বেড়ে ৩৫ টাকা ৫০ পয়সার শেয়ার হয়েছে ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা।
বেশ কয়েকদিন পর ব্যাংক খাতের শেয়ারদর বাড়ল
তারপরই আছে সিটি ব্যাংক। ২.৪৬ শতাংশ বেড়ে শেয়ার দর ২৮ টাকা ৪০ পয়সা থেকে হয়েছে ২৯ টাকা ১০ পয়সা।
ব্র্যাক ব্যাংকের দর ২.৪৩ শতাংশ বেড়ে ৪৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে হয়েছে ৫০ টাকা ৫০ পয়সা।
ব্যাংক এশিয়ার দর বেড়েছে ২.০১ শতাংশ। ১৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে শেয়ারদর হয়েছে ২০ টাকা ৩০ পয়সা।
ব্যাংক খাতে দর বাড়লেও কমেছে আর্থিক খাতে। ২৩টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত ছিল। বাকিগুলোর মধ্যে দর কমেছে ১৩টির, বেড়েছে ৬টির, তিনটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
এই খাতে লেনদেন ছিল ১৮৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৯৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
বিমায় দরের সঙ্গে কমেছে লেনদেনও
মঙ্গলবার বিমা খাতের মোট লেনদেন হয়েছিল ২০০ কোটি ১০ লাখ টাকা। সেটি কমে হয়েছে ১৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সোমবার এ খাতের লেনদেন ছিল ২৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এই খাতের ৫১টি কোম্পানির মধ্যে দর কমেছে ৩৮টির, বেড়েছে ৯টির। অপরিবর্তিত ছিল বাকিগুলোর দর।
দর বৃদ্ধির তালিকায় সবচেয়ে ওপরে ছিল জীবন বিমা খাতের দুটি কোম্পানি। সবচেয়ে বেশি ৭.৩৯ শতাংশ বেড়েছে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর। ৪৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২ টাকা ৩০ পয়সা।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানির দর ৩৭ টাকা থেকে ৫.১৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৮ টাকা ৯০ পয়সা।
ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৬৩ টাকা থেকে ১.৯০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬৪ টাকা ২০ পয়সা।
দর পতনের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, যার দর কমেছে ৩.৪৩ শতাংশ। পর্ষদ পুনর্গঠন করা ফারইস্ট লাইফের দর কমেছে ২.৭৬ শতাংশ। ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের দর কমেছে ২.৪২ শতাংশ।
প্রিমিয়ার ইন্স্যুরেন্স, জনতা ইন্স্যুরেন্স, পপুলার লাইফ, সোনারবাংলা ইন্স্যুরেন্স, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, নর্দান ইন্স্যুরেন্সে, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে।
মুনাফা উত্তোলনের চাপ প্রকৌশল খাতে
চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানিগুলোর দর বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। একই সঙ্গে এ খাতে নতুন বিনিয়োগের পরিমাণও পর্যাক্রমে বাড়তে দেখা গেছে। তবে বুধবার মুনাফা উত্তোলনের চাপ ছিল এ খাতে। ফলে আগের দিনের তুলনায় বিনিয়োগও কমেছে।
বুধবার প্রকৌশল খাতের মোট লেনদেন হয়েছিল ৩১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছিল ৪০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সপ্তাহের শুরুতে রোববার প্রকৌশল খাতের মোট লেনদেন হয়েছিল ৩২৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সোমবার লেনদেন হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
বুধবার এ খাতের লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ২২টির। দর কমেছে ১৯টির। ৪০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
অন্যান্য খাতের লেনদেন
দরপতন হলেও সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বস্ত্র খাতে। এই খাতে হাতবদল হয়েছে মোট ৩৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার শেয়ার। ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে ১৭টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৩৭টির দর। অপরিবর্তিত ছিল বাকি চারটির দর।
আগের দিনও এই খাতে লেনদেন ছিল সম পরিমাণ।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দর পতন হয়েছে ১৭টির, বেড়েছে ১২টির। হাতবদল হয়েছে ৩১৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ২৮৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সোমবার লেনদেন হয়েছিল ২৬১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে যেসব পাঁচ খাতে
আগ্রহ দেখা গেছে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে। ২০টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১২টির, কমেছে ৭টির। লেনদেন হয়েছে ১৭০ কোটি ০৯ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৮৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সোমবার লেনদেন হয়েছিল ১১২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
বিবিধ খাতের ১৪টি কোম্পানির মধ্যে দাম কমেছে ৫টির, বেড়েছে ৮টির। হাতবদল হয়েছে ১২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১৯৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
তথ্য প্রযুক্তি খাতে ১১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৪টির, কমেছে ৭টির। লেনদেন হয়েছে ৫৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
মিউুচ্যয়াল ফান্ড খাতে লেনদেন হয়েছে ৩৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৪২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ১৭টি ইউনিটের দর বেড়েছে, কমেছে ৭টির।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫৫ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৯৬ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২০ দশমিক ০৯ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭১ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ২৯ দশমিক ৬০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬১৩ পয়েন্টে।
লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৮১ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৯৭৯ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।