প্রায় এক শ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে শতাধিক কোটি টাকা লেনদেন করা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মকর্তা আতিকুর রহমান নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, দেশের ১৫টি ব্যাংকে আতিকুর রহমানের ৯৭টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ব্যাংকে ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে।
সোমবার দুপুরে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আতিকুর জানান, চাকরির আগে থেকেই তিনি একজন ব্যবসায়ী। এসব টাকা তার ব্যবসার টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ রয়েছে।
দুদক সচিব মুহা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইডিয়ালের কর্মচারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আতিকুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছিল, তিনি তা দিয়ে গেছেন। এখন আমরা এগুলো ধরে ধরে অনুসন্ধান ও তদন্ত করব।’
গাজীপুরের কালিগঞ্জের এক কৃষক পরিবারের সন্তান আতিকুর। শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। ২০০৪ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন তিনি। ২০১৫ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। যদিও এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কোনো পদ নেই।
তবে আইডিয়ালে চাকরি পাওয়ার পরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে আতিকুরের। কোটিপতিদের তালিকায় নাম উঠেছে অনেক আগে। ঢাকায় একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক তিনি; ব্যবহার করেন দামি গাড়ি।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইডিয়াল স্কুলে যোগ দেয়ার আগে আতিকুর কনকর্ড নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আয়কৃত অর্থ দিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
তার নামে রামপুরার বনশ্রী মসজিদ মার্কেটে বিশ্বাস নামে লাইব্রেরি, আফতাবনগরে বি ব্লকে বিশ্বাস বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান, রামপুরা বনশ্রী এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ১২ নম্বর প্লটে ভিশন-৭১ নামে একটি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান, আফতাবনগরে চারটি বাড়ি এবং বনশ্রীতে আরেকটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, বনশ্রী এলাকায় খান ফিলিং অ্যান্ড এলপিজি, আফতাবনগরে ন্যাশনাল ফ্রায়েড কিচেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম আতিক সোমবার আতিকুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
পরে সাংবাদিকদের আতিকুর বলেন, ‘আমার বাবা কৃষক, আমি কৃষকের ছেলে। আমার বাড়তি কোনো সম্পত্তি নেই, যা আছে ডেভেলপার ব্যবসা থেকে অর্জিত। বনশ্রী ও আফতাব নগরে যে বাড়ি সেটা আমার নয়, ডেভেলপার কোম্পানির।’
অভিযোগ রয়েছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবৈধ ভর্তিসহ সব বাণিজ্যের হোতা এই আতিকুর রহমান। তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস (পোশাক) তৈরি, ক্যানটিন, লাইব্রেরি সবই তার নিয়ন্ত্রণে। এমনকি স্কুলের সামনে ফুটপাতে শতাধিক দোকান বসিয়েও তিনি আয় করেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানে যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ হয় তার সবই করেন আতিক। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তারই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট।
গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী নিয়োগে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। এসব নিয়োগের একটি অংশ আতিকুরের পকেটেও এসেছে বলে অভিযোগ আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আতিকুর বলেন, ‘ভর্তি বাণিজ্যের যে অভিযোগের কথা বলছেন সেটা আমি করি না। অন্য কেউ করে থাকতে পারেন। আমি চুক্তিভিত্তিক চাকরি করি। আমি প্রশাসনিক কর্মকর্তা নই।’
গত ৮ আগস্ট আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তা তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়।