বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শেষ বুলেটেও সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ

  •    
  • ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:৫৬

নূর মোহাম্মদ বারবার অবস্থান বদল করে পাকিস্তানি সেনাদের বিভ্রান্ত করার জন্য গুলি ছুড়তে থাকেন।একপর্যায়ে একটি মর্টারের গোলায় তার ডান পা উড়ে যায়। এমন সময়েও সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সুযোগ দিতে নূর মোহাম্মদ তার শেষ বুলেটটি খরচ করেন।

সামনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, পাশে আহত সহযোদ্ধা। নিতে হয়েছিল ত্বরিত সিদ্ধান্ত। এক হাতে এলএমজি নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন, আরেক হাতে আহত সহযোদ্ধাকে বয়ে নিতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ে। সেই সিদ্ধান্তে সহযোদ্ধারা সেদিন বেঁচেও যান, পাক বাহিনীও পিছু হটে। তবে, শহীদ হন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের। মুক্তিযুদ্ধে এই অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নূর মোহাম্মদ পান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব।

বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সন্তানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে নড়াইলের মহিষখোলা গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন্নেসাকে অল্প বয়সেই হারান তিনি। শৈশবে তিনি ছিলেন ডানপিটে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯৫২ সালে নিজ গ্রামেরই তোতাল বিবিকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ছিল দুই সন্তান। ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন এবং ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান শেখ মো. গোলাম মোস্তফা।

নূর মোহাম্মদ ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআরে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দিনাজপুর সীমান্তে। ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই তাকে যশোর সেক্টরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান।

১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এস এ মঞ্জুর। নূর মোহাম্মদ যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন।

একাত্তরের ৩০ মার্চ ইপিআরের যশোর সেক্টরের সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। নূর মোহাম্মদ ছিলেন তাদের অন্যতম। বয়রা সাব-সেক্টরের অধীনে নূর মোহাম্মদকে তার সাহসিকতা এবং নেতৃত্বসুলভ গুনাবলির জন্য একটি কোম্পানি প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।

ঝিকরগাছার গঙ্গানন্দপুর পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে কাশীপুর হয়ে বয়রা পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা ছিল দুটি। একটি হলো গঙ্গানন্দপুর-গোয়ালহাটি-আটুলিয়া-গুলবাগপুর-বেংদহ-কাশীপুর-বয়রা। অন্যটি গঙ্গানন্দপুর-বিষহরি-মৌতা-বেলতা-কাশীপুর-বয়রা। তাদের আসার দুই পথেই মুক্তিবাহিনীর তরফে কড়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। চালু রাখা হয় সার্বক্ষণিক টহল ব্যবস্থাও।

৫ সেপ্টেম্বর একটি টহল দলের দায়িত্বে গোয়ালহাটিতে ছিলেন নূর মোহাম্মদ। তার সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া ও মোস্তফা। মূল দল ছিল আরও পেছনে আটুলিয়ার দিকে।

তখন পড়ন্ত বেলা। ১৫০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা ও রেঞ্জারের একটি দল গঙ্গানন্দপুর থেকে গোয়ালহাটির দিকে এগোতে থাকে। ওদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নূর মোহাম্মদ ও তার দুই সঙ্গী নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এলএমজি ছিল নান্নু মিয়ার হাতে, পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি লাগে তার শরীরে। তিনি গুরুতর আহত হন।

নূর মোহাম্মদ নিজ কাঁধে আহত সহযোদ্ধাকে তুলে নেন, হাতে নেন এলএমজি। নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পেছাতে পেছাতে গুলি ছুড়তে থাকেন তিনি। এ সময় মোস্তফা কাছাকাছি এসে পড়ায় নূর মোহাম্মদ তাকে নির্দেশ দেন নান্নু মিয়াকে নিয়ে আরও পেছনে মূল অবস্থানে চলে যেতে।

নূর মোহাম্মদ বারবার অবস্থান বদল করে পাকিস্তানি সেনাদের বিভ্রান্ত করার জন্য গুলি ছুড়তে থাকেন। একপর্যায়ে একটি মর্টারের গোলায় তার ডান পা উড়ে যায়। এমন সময়েও সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সুযোগ দিতে নূর মোহাম্মদ তার শেষ বুলেটটি খরচ করেন।

নান্নু মিয়াকে নিরাপদে মূল ঘাঁটিতে রেখে আরও সহযোদ্ধাদের নিয়ে মোস্তফা ফিরে আসেন যুদ্ধে। আধা ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধ শেষে ২৩টি লাশ পিছে ফেলে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযোদ্ধারা গোয়ালহাটিতে জঙ্গলের ভেতর খুঁজে পায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের দেহ। হানাদাররা নূর মোহাম্মদকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। তুলে নিয়ে ছিল তার দুটি চোখও।

নূর মোহাম্মদের দেহ কাশিপুর নেয়া হলে ক্যাপ্টেন হুদা বয়রা থেকে সেখানে ফেরেন। মাথার টুপি খুলে অভিবাদন জানান তার প্রিয় সহকর্মীকে। বয়রা সাব-সেক্টরের সাহসী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা শিশুর মতো সেদিন চোখের পানিতে বুক ভাসান। নূর মোহাম্মদের লাশ ছুঁয়ে শপথ নেন, যেভাবেই হোক গঙ্গানন্দপুর থেকে শত্রু হটিয়ে মুক্ত করবেন।

সামরিক মর্যাদায় কাশিপুর-বয়রা সড়কের পাশে নূর মোহাম্মদকে সমাহিত করা হয়।

যশোরের সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তঘেঁষা গ্রাম কাশিপুর। ওপারে ভারতের চব্বিশ পরগনার বয়রা। বাংলাদেশ সীমান্তের গোবিনাথপুর আর কাশিপুর মৌজার সীমানার কাশিপুর পুকুরপাড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদসহ সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের স্মৃতিস্তম্ভ।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হন নূর মোহাম্মদ। তার স্মৃতি রক্ষার্থে নড়াইলের নূর মোহাম্মদ নগরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর এবং স্মৃতিস্তম্ভ’। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়।

এ বীরশ্রেষ্ঠের ৫০তম শাহাদাতবার্ষিকী রোববার।

নানা আয়োজনে দিনটি পালন করে নড়াইলের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখ ট্রাস্ট।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে নূর মোহাম্মদ নগরে শোক র‌্যালি, স্মৃতিস্তম্ভে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো, পুলিশের সশস্ত্র সালাম, কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর