রাজধানীর যানজট নিরসনে নেয়া দুটি বড় প্রকল্পের একটি মেট্রোরেল পরীক্ষামূলক পর্যায়ে চলে গেছে। অপর প্রকল্প ঢাকা এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়া।
২০১১ সালের শুরুতে নেয়া হয় এই উড়ালসড়ক নির্মাণ প্রকল্প। ঢাকার উত্তর ও পূর্ব – এ দুই প্রবেশপথে যানবাহনের চাপ কমাতে এটি চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। ঢাকার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ যানজট কমে যাওয়ার কথা এ উড়াল সড়কের মাধ্যমে।
কিন্তু গত এক দশকে এর কাজ তো শেষ তো দূরের কথা, সার্বিক অগ্রগতি এক-তৃতীয়াংশও নয়। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিন বছরের প্রকল্পটি কত বছরে শেষ হবে?
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা জটিলতা পার করে এ প্রকল্প এখন গতি পেয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ কাজ হবে। দুই বছরে বা ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা হবে পুরো প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, গত জুন পর্যন্ত এর কাজ হয়েছে ২৭ শতাংশের কম।
ঢাকা এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের প্রথম অংশের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। দ্বিতীয় অংশের কাজও ভালোই চলছে। সবটুকু এক সঙ্গে খোলা হবে।
‘তবে যেহেতু প্রথম দুই অংশের কাজ প্রায় শেষ, তাই আগামী জুনের মধ্যে তেজগাঁও রেলওয়ে পর্যন্ত অংশ খোলা যায় কি না এটা নিয়ে কাজ করছি, যাতে একটু আগে খুলে দিলে জনগণ তার সুফল পেতে পারে। তবে এটার নির্দিষ্ট কোনো টাইমলাইন নাই। পুরো প্রকল্পের কাজ আগামী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যেই শেষ করার জোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, জমি অধিগ্রহণ ও বিনিয়োগ জটিলতা কেটে যাওয়ায় কিছুটা গতি এসেছে দেশের প্রথম উড়ালসড়ক প্রকল্পে। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার ৪০০ পিলার, যার ওপরে বসেছে আই গার্ডারও। এ অংশে বেশির ভাগ নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ করা হয়েছে।
কোন অংশের অগ্রগতি কতটুকু
২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বনানী তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর যাত্রাবাড়ী হয়ে চিটাগাং রোডে গিয়ে শেষ হবে। মূলত রেললাইনের উপর দিয়ে চলা এ উড়ালসেতু নির্মাণ হচ্ছে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের কাজ হয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হয়েছে ১৭ শতাংশ।
বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অংশে ১ হাজার ৪৪২টি পাইল বা পিলারের মধ্যে ১ হাজার ৪৩০টি, ৩২৯টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ২৬৬টি, ৩২৯টি কলামের মধ্যে ২৫২টি, ৩২৯টি ক্রস-বিমের মধ্যে ২১০টি এবং ৩ হাজার ৭২টি আই গার্ডারের মধ্যে ৯৫৪টির নির্মাণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩ হাজার ৭২টি আই গার্ডারের মধ্যে ৭২৫টি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।
বনানী রেলস্টেশন ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডসহ আরও কিছু নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচটি স্থানে টেস্ট ফাইল, রেললাইনের উভয় পাশে বেড়া নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় এবং বনানী রেলস্টেশন এলাকায় ১ হাজার ৯৯৪টি পাইলের মধ্যে ৯৯১টি, ৬৩১টি পাইল ক্যাপের ৯৯টি এবং ৬৩১টি কলামের ৪০টির কাজ শেষ হয়েছে। পাইলিং, পাইল ক্যাপ এবং কলাম নির্মাণের কাজ চলমান আছে। কুড়িল এলাকায় সেন্ট্রাল কন্ট্রোল বিল্ডিংয়ের (সিবিসি) পাইল ড্রাইভিং সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে পাইল ক্যাপের কাজ চলমান আছে। বাকি অংশ বা মগবাজার থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত অংশের দৃশ্যমান কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
পুরো উড়ালসেতুতে ওঠানামার জন্য ৩১টি র্যাম্প থাকবে। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। কোনো বাধা ছাড়াই ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে গাড়ি। বিমানবন্দর এলাকা থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত যেতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগবে। এপথ পাড়ি দিতে এখন দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।
ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ এবং কাঁটাবন হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত উড়ালপথে দুটি সংযোগ সড়ক থাকবে। ফলে এ এলাকার গাড়িগুলোও উড়াল সড়ক ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বছরের শুরুতেই খুলে দেয়া হবে উড়ালসড়কের প্রথম অংশ। আর ২০২৩-এর জুনে পুরো সড়ক খুলে দিলে ঢাকার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ যানজট কমে যাবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
প্রকল্পে দেরির কারণ
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, অনুমোদনের প্রায় দুই বছর পর ২০১৩ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও জমি অধিগ্রহণ ও বিনিয়োগ জটিলতায় কাজে ধীরগতি ছিল। এ ছাড়া, জটিলতা ছিল প্রকল্পের অর্থায়নেও। এ ছাড়া নকশা পরিবর্তনের কারণেও বিলম্ব হয়।
পিপিপি প্রকল্পের আওতায় করা ঢাকা এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ। বাকি ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ করবে বিদেশি কোম্পানি।
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। ইতাল-থাই নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটিকে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেয় সরকার। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে, কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কাজ শুরুই হয়নি।
২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ইতাল-থাই এ প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত করবে, কিন্তু নির্মাণকাজের টাকা জোগাড় করতেই কোম্পানিটি লাগিয়ে দেয় ৯ বছর। এ ছাড়া নকশা বদল ও জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় শুরুতেই দুই বছরের মতো দেরি হয় এ প্রকল্পে।
তবে, গত এপ্রিলে জমি ও বিনিয়োগ নিয়ে সব জটিলতা কেটে গেছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া জটিলতা ছিল ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ বিষয়েও। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই প্রকল্পে ব্যবহৃত পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেনার দাবি করে। তাই প্রকল্পের ভ্যাট-ট্যাক্স বিষয়ে জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গত ১৭ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পিপিপি অফিস, প্রকল্প অফিস ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ জটিলতারও অবসান হচ্ছে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প পরিচালক এম এস আকতার বলেন, ‘এ প্রকল্পের যেসব সমস্যা ছিল তা কেটে গেছে। জমি বা টাকা নিয়ে এখন আর কোনো সমস্যা নেই, সব মিটে গেছে। তিন অংশে ভাগ করে এ প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত আগে শেষ হবে। এরপর বনানী রেল স্টেশন থেকে মগবাজার রেল স্টেশন পর্যন্ত অংশের কাজও অনেক এগিয়েছে। সব শেষে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ। মূল উড়াল সড়কের মতো সাপোর্ট প্রকল্পেও বেশ গতি এসেছে। এরই মধ্যে সাপোর্ট প্রকল্পের কাজ প্রায় ৮২ শতাংশ শেষ হয়েছে।
সিংহভাগই বেসরকারি বিনিয়োগ
সেতু বিভাগের বাস্তবায়নাধীন উড়াল সড়কটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) নেওয়া প্রকল্প। সেতুটি দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবাায়িত হচ্ছে। মূল কাঠামো নির্মাণে হবে পিপিপি অর্থায়নে। সহযোগী প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে সরকারি অর্থে।
মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করবে সরকার। বাকি ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। শুরুতে মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ধরা হয়।
সহযোগী প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা করা হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দশক আগে সরকার পদ্মা সেতুর পরই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল ঢাকার যানজট নিরসনের দুটি প্রকল্পে। এর একটি মেট্রোরেল, অপরটি উড়ালসড়ক প্রকল্প।
সময় ক্ষেপণের কারণে উড়ালসড়ক প্রকল্পটির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঢাকাবাসী। একই সঙ্গে সরকারের অর্থও অপচয় হচ্ছে। সহজেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো প্রকল্পের একটা টাইম ভ্যালু আছে। নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা গেলে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যায়। কেন যে এ রকম একটা প্রকল্প ১০ বছর ধরে আলোর মুখ দেখল না, তা বোধগম্য নয়।
‘অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিয়েই তো এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যদিও আরও কম ব্যয়ে প্রকল্পটির বিকল্প অন্য প্রকল্পও নেয়া যেত। তবে যেহেতু প্রকল্পটি নেয়া হয়েছেই, তাহলে তাতে এতো দেরি কেন? এর কারণে চতুর্মুখী ক্ষতি হচ্ছে। এটা হওয়ার মাধ্যমে যা কিছু লাভ হতো, তা তো এখনও পেলামই না। এটার কারণে যে লো-কস্ট প্রজেক্টগুলো হলো না, তার সুবিধাও পেলাম না। তবে এখনও দ্রুত শেষ করলে কিছু হয়তো সুবিধা মিলবে।’