হারিয়ে যেতে বসা দেশীয় জাতের মাছ কাকিলা পুকুরে চাষের উপায় বের করলেন যশোরের মৎস্যবিজ্ঞানীরা।তিন বছর গবেষণার পর যশোরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে মাছটির কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেন তারা।
এ নিয়ে দেশীয় ৩১ প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন হলো।
ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) স্বাদু পানি উপকেন্দ্র, যশোরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কমকর্তা রবিউল আউয়াল হোসেন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কমকর্তা শরীফুল ইসলাম এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিশির কুমার দে ওই গবেষণা পরিচালনা করেন।‘কাকিলা’ নামে সুস্বাদু এই মাছটি ভোজনরসিকদের নিকট ছিল অমৃতসম। মানব দেহের জন্য উপকারী অনুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাঁটা কম।
অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে এ মাছটির প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মাছটি এখন দুর্লভ হয়ে গেছে।
গবেষক শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘কাকিলা বা কাখলে একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ। এর দেহ সরু, ঠোঁট লম্বাটে এবং ধারালো দাঁতযুক্ত। বাংলাদেশে যে জাতটি পাওয়া যায় সেটি মিঠা পানির জাত। মাছটি বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে কাইকল্যা, কাইক্কা নামেই বেশি পরিচিত।’তিনি জানান, বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে এ মাছ পাওয়া যায়। তবে রং ও আকারে কিছু পার্থক্য থাকে।গবেষক দলের প্রধান রবিউল আউয়াল হোসেন জানান, কাকিলার দেহ লম্বা এবং সামান্য চাপা এবং প্রায় সিলিন্ডার আকৃতির। এগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার হয়। পরিণত পুরুষ মাছের মাথার শীর্ষে লাল চূড়া দেখতে পাওয়া যায়, যা থেকে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা করা যায়। পুরুষ মাছের দেহ স্ত্রী মাছের তুলনায় অধীত সরু এবং আকারে একটু ছোট হয়। এটি শিকারি মাছ।
তিনি জানান, প্রাকৃতিকভাবে প্রবহমান জলাশয়ে বিশেষ করে নদীতে এবং বর্ষাকালে প্লাবিত অঞ্চলে প্রজনন করে থাকে। পরিণত মাছেরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ নেই, এমন স্থানে বসবাস করলেও জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচে ও ভাসমান শেকড়ে এদের স্ত্রীরা ডিম পাড়ে।কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন এটিই বাংলাদেশ প্রথম এবং বিশ্বের কোথাও এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন রবিউল আউয়াল হোসেন।শরীফুল ইসলাম জানান, রাজবাড়ী জেলাসংলগ্ন কুষ্টিয়ার পদ্মা নদী থেকে কাকিলা ব্রুড (মা-বাবা মাছ) মাছ সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে যশোরে এনে যশোরের স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের পুকুরে ছাড়া হয়। পরে হ্যাচারিতে উৎপাদিত কার্পজাতীয় মাছের জীবিত পোনা এবং নানা জলাশয় থেকে সংগৃহীত জীবিত ছোট মাছ খাইয়ে পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশে মাছকে অভ্যস্ত করা হয়।মা-বাবা মাছকে একত্রে একটি চৌবাচ্চায় রেখে ঝর্ণাধারা দিয়ে সেখানে কচুরি পানা রাখা হয়। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিমের ভেতরে বাচ্চার বিভিন্ন দশা ও উন্নয়ন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ডিম ছাড়ার প্রায় ৯০ থেকে ১০০ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। ২৫ আগস্ট প্রজনন করা মাছের ডিম থেকে পোনা বের হয়। এভাবে গবেষক দলের অপর সদস্য শিশির কুমার দে বলেন, কাকিলা মাছের প্রজননের ট্রায়ালের সময় চৌবাচ্চার পানির গড় তাপমাত্রা ছিল ২৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ৪.৫ মিলিগ্রাম/লিটার, পিএ্ইচ ছিল ৭.৬।গবেষকরা জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কাকিলা মাছে ১৭.১ শতাংশ প্রোটিন, লিপিড ২.২৩ শতাংশ, ফসফরাস ২.১৪ শতাংশ এবং ০.৯৪ শতাংশ ক্যালিসিয়াম রয়েছে, যা অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি।
যশোর জেলা মৎস্য কমকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘শিকারি মাছ হওয়ায় কাকিলার কৃত্রিম প্রজনন অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে প্রথম কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন সফলতা লাভ করেছে। ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে মাছটি রক্ষা পাবে।
‘এখন পুকুরে চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে চাষের আওতায় নিয়ে এলে দেশবাসী আবার সুস্বাদু এ মাছটির স্বাদ নিতে পারবে।’বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘দেশের বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ৩০টি মাছের কৃত্রিম প্রজননে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সফলতা লাভ করেছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় ৩১তম মাছ হিসেবে কাকিলা মাছ যুক্ত হলো।’তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে সকল বিপন্ন প্রজাতির মাছকে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা হবে, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষের খাবার প্লেটে দেশীয় মাছ থাকে। এ জন্য ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, মৎস্য অধিদপ্তর অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব দেশীয় মাছ সংরক্ষণ উন্নয়নে কাজ করছে। আমরা হারিয়ে যাওয়া দেশীয় মাছের স্বাদ মানুষের নিত্যদিনের খাদ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই। এ জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের যশোর, সৈয়দপুর, সান্তাহার ও ময়মনসিংহ কেন্দ্র থেকে গবেষণা করা হচ্ছে এবং এতে সফলতাও আসছে।’