ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ওমর ফারুক ‘ভালোবেসে’ বিয়ে করেছিলেন আরেক ট্রাফিক সার্জেন্টকে। অভিযোগ উঠেছে, ওই নারী সার্জেন্টকে বিয়ের পরপরই নানা ধরনের নির্যাতন করেন সার্জেন্ট ফারুক। এই স্ত্রী ও পুলিশ বাহিনীর অনুমতি না নিয়ে ২০২০ সালেরই ২৬ ডিসেম্বর গোপনে বিয়ে করেন ময়মনসিংহের ভালুকার এক নারীকে, যার সঙ্গে তিনি পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন। ফারুক এর আগে তাকে ‘ভুয়া ডিভোর্স লেটার’ও পাঠান। এসব অভিযোগ এনে দুটি মামলাও করেছেন এই নারী সার্জেন্ট।
তবে সার্জেন্ট ফারুকের দাবি, ২০২০ সালের ১ আগস্ট রাজধানীর এক থানায় জোর করে তাকে ধরে নিয়ে বিয়ে করেন এই নারী সার্জেন্ট। এর তিন দিনের মাথায়ই তিনি তাকে তালাক দেন। তারপর ২০২০ সালেরই ২৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
ওই নারী সার্জেন্ট তার বিরুদ্ধে প্রথম ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেন। এরপর ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ভুয়া ডিভোর্সের অভিযোগ এনে জালিয়াতির মামলা করেন তিনি। আদালতের নির্দেশে নারী নির্যাতনের মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং ডিভোর্স নিয়ে জালিয়াতিসংক্রান্ত মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের তদন্তে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না।
এই নারী সার্জেন্ট মামলায় বলেছেন, সার্জেন্ট ফারুকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এরই একপর্যায়ে ২০২০ সালের ১ আগস্ট তারা বিয়ে করেন। কিন্তু সংসারজীবনে ফারুক সুশৃঙ্খল ছিলেন না। অন্য নারীদের প্রতি তার আসক্তি ছিল লক্ষণীয়। তিনি ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন অন্য নারীদের সঙ্গে। স্ত্রী থাকার পরও তিনি ময়মনসিংহের ভালুকা থানার এক তালাকপ্রাপ্ত নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এ পরকীয়ার জের ধরেই তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এরপর চলতে থাকে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এই নারী বলছেন, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য যখন তিনি মরিয়া, তখন তার স্বামী সার্জেন্ট ফারুক তাকে বেতনের টাকা দেয়া ও মোটরসাইকেল কিনে দেয়াসহ নানা ধরনের শর্ত দেন। একসময় সহ্য করতে না পেরে পুলিশ বিভাগে অভিযোগ করেন। অভিযোগটি অমীমাংসিত অবস্থায়ই তার অনুমতি ও পুলিশ বিভাগের অনুমতি না নিয়ে গোপনে ময়মনসিংহের সেই নারীকে বিয়ে করেন সার্জেন্ট ফারুক। এর ফাঁকে মামলা ও চাকরি হারানোর ভয়ে তাকে ‘ভুয়া ডিভোর্স’ লেটার পাঠান তিনি।
এই নারী সার্জেন্টের অভিযোগ, উপায় না দেখে, কথিত তালাকের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং এলাকার চেয়ারম্যান ও গাজীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান তালাকের কোনো নোটিশ পাননি বলে জানান। ডাক বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল জানান, ডাকঘর থেকে রেজিস্ট্রেশন পত্র দুটি পাঠানো হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট তার আদেশে এই তালাক নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া সার্জেন্ট ফারুক নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বরত অবস্থায় তালাক নিবন্ধিত হয়। এ ঘটনায় কাজির সঙ্গে ওমর ফারুকের যোগসাজশ ছিল।
এরপর এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা তার সার্জেন্ট স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এবং ঢাকার সিএমএম কোর্টে পৃথক মামলা করেন। আদালত শুনানি শেষে নারী নির্যাতনের মামলাটি পিবিআই এবং বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ জালিয়াতির মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ইশরাত হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের জন্য আমার মক্কেলকে ব্যাপক হয়রানি করা হচ্ছে। আসামির তিন ভাই পুলিশ। এর মধ্যে একজন র্যাবে, একজন থানায় এবং আসামি ফারুক মাদারীপুরে সার্জেন্ট হিসেবে কর্মরত। আসামি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ডিভোর্সের কাগজ প্রস্তুত করেছেন। যেখানে একজন নাবালককে সাক্ষী করা হয়েছে। আসামিরা প্রভাব খাটালেও সুষ্ঠু তদন্ত হলে অপরাধ প্রমাণিত হবে।’
গাজীপুরের ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া জবানবন্দিতে এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সার্জেন্ট ওমর ফারুকের সঙ্গে তার তালাকের বিষয়ে ডাক বিভাগের মাধ্যমে যথাযথভাবে নোটিশ প্রেরণ না করেই তালাক কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর যেদিন তালাক নিবন্ধন করা হয়, তখন তার স্বামী সার্জেন্ট ওমর ফারুক টাঙ্গাইল জেলায় কর্তব্যরত ছিলেন। কাজেই ওমর ফারুকের অনুপস্থিতিতেই কাজি সাখাওয়াত হোসেন তালাকটি নিবন্ধন করেন।
অপরদিকে অভিযুক্ত কাজি সাখাওয়াত হোসেন লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যে জানান, ওমর ফারুকের তালাকনামার নোটিশটি তার অফিস থেকে ২০২০ সালের ১০ আগস্ট ওই নারী কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। চান্দনা চৌরাস্তা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে ওই নারীর স্থায়ী ঠিকানার চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয় তালাকনামাটি। নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পার হলে তিনি তালাকটি রেজিস্ট্রি করেন। তবে নোটিশটি যথাযথ ঠিকানায় পৌঁছানোর গাফিলতি পোস্ট অফিসের রয়েছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন কাজি সাখাওয়াত নিজেই।
এই দম্পতির বিষয়টি নিয়ে গাজীপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের রেকর্ডের জন্য আদেশনামায় বলা হয়েছে, অভিযোগকারী নারীর তালাক নিবন্ধনের বিষয়টি ডাক বিভাগের মাধ্যমে নোটিশ প্রাপ্তি সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসের সংরক্ষিত রেজিস্ট্রিসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র এবং নোটিশ প্রাপ্তির পর নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার বিষয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, যা অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হতে পারে। নিকাহ নিবন্ধন ও তালাক নিবন্ধন একটি সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এ বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজিকে অবশ্যই অধিকতর দক্ষ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। ওই ঘটনায় কাজি ও বাদীর স্বামী সার্জেন্ট ওমর ফারুকের যোগসাজশ রয়েছে।
‘জোর করে থানায় নিয়ে বিয়ে’
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সার্জেন্ট ওমর ফারুক নিউজবাংলার কাছে পাল্টা অভিযোগ করেন, গত বছর ১ আগস্ট তিনি গাজীপুরে চাকরি করার সময় ফোন করে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাসায় ডাকেন অভিযোগকারী নারী পুলিশ কর্মকর্তা। বাসায় যাওয়ার পর তার বোনসহ কাজিকে দেখতে পান। ওই সময় তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নিজাম তাকে থানায় তুলে নিয়ে যান। তারপর থানায় তাদের জোর করে বিয়ে দেয়া হয়।
সার্জেন্ট ফারুক বলেন, ‘আমাদের ভেতরে কোনো প্রেম ছিল না। আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন ওই নারী কর্মকর্তা। সেখানে অন্যান্য পুলিশও উপস্থিত ছিল। বিয়ে হওয়ার তিন দিনের মাথায় আমি ডিভোর্স দিয়ে দিই। কারণ সে ভালো না।’
স্ত্রীকে নির্যাতন ও ভুয়া ডিভোর্সের ব্যাপারে জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি কোনো নির্যাতন করিনি। তার নিজের অনেক ক্ষমতা। বিয়ের তিন দিন পর থেকে আমি আর কোনোদিন তার সঙ্গে থাকিনি। নির্যাতনের কোনো প্রশ্নই আসে না। আর ডিভোর্সও সঠিকভাবে দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে আবার বিয়ে করার জন্য গত এক বছর নানাভাবে পেরেশানি করছেন তিনি। ক্ষমতা দেখিয়ে আমার এলাকার চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ভুয়া রিপোর্ট নিয়েছেন। এসব কিছুসহ তার নানা অভিযোগের কথা পুলিশ সদরদপ্তরসহ বহু জায়গায় বিলি করে বেড়িয়েছেন।’
দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি তো তাকে বিয়ের তিন দিনের মাথায় তালাকই দিছি। তাহলে আমার পরবর্তী বিয়ের জন্য তার কাছ থেকে কেন অনুমতি নিতে হবে? আমি সঠিক নিয়মেই বিয়ে করেছি।’
নারী নির্যাতন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) ফরিদা পারভীন লিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্তে অনেক কিছুই এসেছে। কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ অল্প সময়েই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হবে।’