অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ‘হাফেজ’ আহমেদ আল রাজির সঙ্গে গত বছরের শুরুতে অনলাইনে পরিচয় ঢাকার মেয়ে নুসরাত শারমিনের (ছদ্মনাম)। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়। বিয়ের জন্য ‘পাগলপ্রায়’ হয়ে ওঠেন ছেলেটি। কিন্তু তার পরিবারের ছিল ঘোরতর আপত্তি।
ছেলেটি তখন মেয়েটিকে এই বলে বোঝান, ‘সংসার তো আমরা করব; আমরা হ্যাপি থাকলেই সব ঠিক।’ তার এমন আশ্বাসে পরিবারকে একরকম জোর করেই বিয়েতে রাজি করান মেয়েটি। এভাবে পরিচয়ের তিন মাস না পেরোতেই অস্ট্রেলিয়ায় বসে মেয়েটির বাসায় কথিত কাজি ও দুই বন্ধুকে পাঠিয়ে অনলাইনে বিয়েও করেন ছেলেটি।
এর প্রায় এক বছর পর দেশে আসেন আল রাজি; নিজেদের মোহাম্মদপুরের ভাড়াবাসায় না উঠে মেয়েটিকে নিয়ে রাজধানীর একটি হোটেলে ওঠেন। সেখানে দুই দিন থাকার পর উত্তরার একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা। সেই বাসায় ওঠার পরই ছেলেটি ‘আজেবাজে’ কথা বলা শুরু করেন।
ওই তরুণী বলছেন, পেটে সন্তান আসার খবরে ‘তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে’ আল রাজি, গলা টিপে হত্যারও চেষ্টা করে। ‘ডিভোর্স দিয়ে দিছি’ বলে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে। ছেলেটির পরিবারের সদস্যরাও তাকে হত্যার হুমকি দেয়। এরই একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে গত ১১ মে বাবার বাড়ি চলে গেছেন মেয়েটি।
এই তরুণীর অভিযোগ, ‘স্বপ্নের সংসার’ ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার আগে তুরাগ থানায় গিয়েছিলেন তার সঙ্গে প্রতারণার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে। কিন্তু থানা থেকে জানানো হয়, এক দিন আগেই ছেলেটি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে গেছেন। তাই তারা তার অভিযোগ নিতে পারবে না। এদিকে ছেলেটিকে তার পরিবার আবারও বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনাগত সন্তান আর পরিবারের কথা ভেবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন নুসরাত। তিনি যে প্রতারিত হয়েছেন সে বক্তব্যের ভিডিও প্রস্তুত করেন ফেসবুকে ছাড়ার জন্য। বিষয়টি জানান কাছের বন্ধুদের। সেই ভিডিওতে তার বাঁচার কোনো ইচ্ছা নেই এবং আল রাজির বিচারের দাবি জানিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন- এমন কথা রেকর্ড করেন মেয়েটি।
এই পরিস্থিতিতে এক বন্ধুর মাধ্যমে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় মেয়েটির। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শনিবার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বিয়ের নামে প্রতারণার শিকার হয়ে এখন আমি ও আমার অনাগত সন্তান জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।’
নুসরাত বলেন, ‘অনলাইনে গত বছরের শুরুতে আমার একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং একটা পর্যায়ে কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে দেড় মাসের মধ্যে উনি আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমরা পারিবারিকভাবে এগোতে চাই।
‘কিন্তু শুরুতেই তার পরিবারের কিছু ব্যবহার আমাদের ভালো লাগেনি। তাই আমরা প্রস্তাবটা বাতিল করতে চাই। কিন্তু ছেলেটা প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমাকে বিয়ে করার জন্য।’
মেয়েটি বলেন, ‘‘সে একজন হাফেজ। সেই সুবাধে তার মিষ্টি কথায় ভরসা করে ফেলি। সে আমাকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, ‘আমরা অনলাইনে বিয়ে করে ফেলি, একটা সময় পরিবার মেনে নেবে। সংসার তো আমরা করব; আমরা হ্যাপি থাকলেই সব ঠিক’।
‘তার কথায় ভুলে আমিও আমার পরিবারকে এই বিয়েতে একপ্রকার জোর করেই রাজি করাই। আমার পরিবারের সবাই তার হাফেজ ও ধর্মভীরু মনোভাব দেখে আমার কথা মেনে নেন।”
এই তরুণী জানিয়েছেন, গত বছরের ৩০ মার্চ অনলাইনে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী আহমেদ আল রাজির সঙ্গে ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় তার।
তিনি বলেন, ‘‘আমি সেই দিন থেকে স্বপ্ন বোনা শুরু করি; একটা মেয়ে ঠিক যেভাবে সংসারের স্বপ্ন বোনে। আমিও নিজেকে তার মনমতো তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে তার পরিবার আমাকে অনেক কটু কথা শোনায়। কিন্তু সব সময় তার সাপোর্ট ছিল। ভরসা দিত ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। তারা সব সময় তাকে আবার বিয়ে করানোর এবং আমাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু সে আমাকে শুধু ধৈর্য ধরতে বলে। আর আমি তাই করি।”
শ্বশুরবাড়ির এমন আচরণের পরও ছেলেটির কথা বিশ্বাস রেখেছিলেন নুসরাত। অপেক্ষায় ছিলেন স্বামীর দেশে আসার।
তিনি বলেন, ‘আমিও তার বাংলাদেশে ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। সে ফিরেও আসে। গত ২৫ মার্চ সে আসে। দীর্ঘ একটা বছর অপেক্ষা করে প্রথমবার আমি তাকে দেখি। প্রথমে হোটেলে উঠি। সেখানে দুজন আলোচনা করে একটা বাসা নিই উত্তরায়। বলে রাখি, তার নিজের বাসা মোহাম্মদপুরে। সে আমাকে ওখানে ওঠায় না এটা বলে যে তার যৌথ পরিবার। এখনো ওনারা আমাকে মেনে নেয়নি। কিছুদিন যাক সব ঠিক হয়ে যাবে।’
কিন্তু কোনো কিছুই আর ঠিক হয়নি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুসরাত। বলেন, ‘আমিও এই আশাতেই থাকি। তবে সপ্তাহ না যেতেই তার আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখতে পাই। নোংরা ভাষায় কথা বলতে থাকে। আমার অসুস্থ বাবাসহ পরিবারের সবাইকে ছোট করতে থাকে। তারা আমাদের থেকে অর্থবিত্তে অনেক এগিয়ে- এটা প্রতিটা মুহূর্তে জাহির করতে শুরু করে।’
‘আমি আগে জব করে সেই টাকা কেন বাসায় দিয়েছি, যেসব ফার্নিচার কিনেছি সেগুলো কেন এই বাসায় আনছি না, আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি, তাহলে বাসা কেন তারা সাজিয়ে দিচ্ছে না- এসব যৌতুকের জন্যও অনেক নির্যাতন করে আমাকে।’
ওই তরুণী আরও বলেন, ‘সে সব সময় এটা বোঝাতে থাকে যে, আমি তার যোগ্য নই। সে ভুল করেছে। বহু ঝগড়া, মারামারি, লোক জানাজানিসহ অনেক ঘটনা হয়। তার পরিবারের মানুষ আমাকে হুমকি দিতে থাকে। প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়।
‘এর মধ্যে আমি জানতে পারি, কনসিভ করেছি। এটা জানার পর তো আমার হাজব্যান্ড তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। এবং যেকোনো মূল্যে বাচ্চাটাকে সে রাখতে চায় না। এটা নিয়ে কথা বলাতে সে আমার গায়ে হাত তোলে। এ ছাড়া নোংরা নোংরা সিনক্রিয়েট করে। বলে তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিছি।’
এরই একপর্যায়ে চলতি মাসে সেই ভাড়া বাসায় তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় বলেও অভিযোগ মেয়েটির।
‘গত ৭ ও ৮ মে আমাকে তালাবদ্ধ করে রাখে। এমনকি আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য উদ্যত হয়। পরে নিজের ও বাচ্চার জীবনের নিরাপত্তা না পেয়ে ১১ মে আমি বাবার বাসায় চলে আসি।
‘কেননা ও আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। আর সবকিছু নিয়ে গিয়ে বাসা ছেড়ে দেয়। আসার আগে আমি তুরাগ থানায় লিখিত অভিযোগ জানাতে চাই। কিন্তু কোনো পুলিশ অফিসার এ বিষয়ে আমাকে সহযোগিতা করেননি। কারণ আমার স্বামী নাকি আগের দিন রাতেই আমার নামে অভিযোগ করে গেছে। কতটা অসহায় আমরা মেয়েরা।’
এ কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন নুসরাত। বেশ কিছুক্ষণ পর তার সঙ্গে আবার কথা বলে নিউজবাংলা।
এ সময় তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ আমার অনাগত বাচ্চা ও আমার জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন। আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছি। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি আমার পরিবারের অশান্তির কারণ হতে চাই না।
‘তার আগে এই বাচ্চার ভবিষ্যৎ কী? আমার জীবনের যে ক্ষতি সে করেছে তার নোংরা স্বার্থ চরিতার্থ করতে, এর প্রতিকার কী? সত্যিই কি দেশের আইন মেয়েদের পাশে আছে? আমি সবার কাছে নিজের আর বাচ্চার সুন্দর একটা জীবন চাই। প্লিজ, হেল্প মি। আমি এই ভদ্র মুখোশধারী প্রতারকের চেহারা সবার কাছে উন্মোচন করে গেলাম। আমি ওর শাস্তি চাই।’
নুসরাতের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পাওয়ার পর আল রাজির বক্তব্য জানতে তার তিনটি মোবাইল নম্বরে গত দুই দিনে অন্তত ২৫ বার ফোন করেন নিউজবাংলার এই প্রতিবেদক। এ সময় তার দুটি নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। একটিতে ফোন ঢুকলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আল রাজিদের মোহাম্মদপুরের ওই ভাড়া বাসায় গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। বাসার মালিককে পাওয়া যায়নি। দারোয়ান জানিয়েছেন, তারা গত মাসেই বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।
নুসরাতকে তুরাগ থানার কোনো কর্মকর্তা কেন সাহায্য করেননি, তা জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, ‘থানায় এসে এ ধরনের অভিযোগ করলে তা নেয়া হবে না- এমনটা হওয়ার কথা না। আমার আসলে জানা নেই। আমাদের যদি কোনো গ্যাপ থেকে থাকে সেটা আমি দেখছি। ভুক্তভোগীকে থানায় পাঠিয়ে দেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ছেলেটার অভিযোগ কী এবং তার সত্যতা পেয়েছেন কি না- এ কথা জানতে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও সাড়া দেননি ওসি মেহেদী হাসান।
বিয়েটা ছিল ভুয়া
২০২০ সালের ৩০ মার্চ অনলাইনে তাদের মধ্যে যে বিয়ে হয়েছিল তার কাবিননামার একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা।
কাবিননামাটি ঘেঁটে দেখা গেছে, দুই পক্ষের সাক্ষীর নাম ও কনের নামের ঘরে সই থাকলেও বরের ঘরে কোনো সই নেই।
কাবিননামায় বরের সই নেই কেন- জানতে চাইলে মেয়েটি বলেন, ‘বিয়ের সময় সে দেশের বাইরে থাকায় তার সই নেয়া যায়নি। ওই সময় সে কাজিকে বলে পাত্রের সইয়ের স্থানটা ফাঁকা থাক। দেশে ফিরেই সই করবে।
‘গত মার্চে ও দেশে আসার পর বারবার বললেও সই করেনি। এখন বুঝতে পারছি, ও প্রতারণা করে আমাকে শুধুই ব্যবহার করেছে। স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না।’
সেই সই নেয়ার জন্য হোটেল ও ভাড়া বাসায় ছেলেটির সঙ্গে উঠেছিলেন জানিয়ে মেয়েটি বলেন, ‘কিছুতেই রাজি হয়নি ও। ওর পরিবার চাইছে ওকে আবার বিয়ে দিতে। আমাকে বলছে ডিভোর্স লেটারে সই করতে।’