সরকারি আইন ও বিধি না মেনেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপো-সিএমএসডি) প্রায় ৯ কোটি টাকার করোনা পরীক্ষার আরটি পিসিআর কিট কেনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি কার্যাদেশ ও ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়াই এসব কিট কেনা হয়েছে।
এর আগে গত বছরেও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও করোনা সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ৩৪৩ কোটি টাকার বিল আটকে আছে।
অভিযোগ উঠেছে, সেই সমালোচনা রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও কোনো রকম চুক্তি ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামান তার ‘পছন্দের কোম্পানির’ কাছ থেকে এক লাখ কিট কিনেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান জিএস বায়োটেকের মাধ্যমে সম্প্রতি ৯ কোটি টাকায় ১ লাখ কিট কিনেছে সিএমএসডি। এসব কিট গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝে নিয়েছে। এর আগে ৬ মে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ ব্যাপারে অনাপত্তি দেয়।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামান গত ৯ মে জিএস বায়োটেক নামের একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই এক লাখ আরটি পিসিআর কিটের সরবরাহ নেন। এই সরবরাহের আগে কোনো ধরনের নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) ইস্যু করা হয়নি।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, সরকারি ক্রয় পদ্ধতিতে যে কোনো সরবরাহ নেয়ার আগে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের মাধ্যমে ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন পেতে হয়। আনুষ্ঠানিক দর কষাকষির পর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রস্তাব ঠিক করে ক্রয় প্রক্রিয়া শুরুর বিধান রয়েছে।
এই অনুমোদন পাওয়ার পর নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড জারি করে কার্য সম্পাদন জামানত ও কার্য সম্পাদন চুক্তি করে সরবরাহ নেয়ার নিয়ম রয়েছে।
তবে এক লাখ কিট কেনার ক্ষেত্রে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামান এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে তার একক সিদ্ধান্তে জিএস বায়োটককে কিট সরবরাহের অনুমতি দেন। কিট সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়াটিই অস্বচ্ছ হওয়ায় এখানে ব্যাপক দুর্নীতির শংকা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি সরবরাহ কাজে কোনো প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। তবে নতুন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান জিএস বায়োটেকের করোনা কিটের রিএজেন্ট নিয়ে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
কিটের কার্টন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, জিএস মূলত একটি গার্মেন্টস কোম্পানি। সিএমএসডি পরিচালকের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে কোনো যোগ্যতা ছাড়াই এই কোম্পানি কিট সরবরাহ করেছে।
করোনা পরীক্ষার আরটি পিসিআর কিট আমদানি করতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এনওসি বা অনাপত্তি নিতে হয়। নিউজবাংলার হাতে আসা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এনওসিতে দেখা যায়, কিট সরবরাহকারী প্রকৃত প্রতিষ্ঠান চিনের সানসিউর কোম্পানি। তবে সরাসরি তাদের কাছ থেকে না এনে হংকংয়ের জাইলি ইন্ডস্ট্রি কোম্পানি নামে তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে এগুলো দেশে আনা হয়েছে।
হংকং থেকে কিট সংগ্রহের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছ থেকে এনওসি নেয়া হয় ২৩ এপ্রিল। এই এনওসি দেয়ার পূর্ব শর্ত হিসেবে ওয়ার্ক অর্ডার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিতে হয়। তবে এগুলো এনওসি পেয়েছে জিএস বায়োটেক।
অভিযোগ আছে, ক্রয় কমিটি থেকে শুরু করে মূল্য যাচাই কমিটিতে একটি একটি চক্র রয়েছে, যার সবাই সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামানের ঘনিষ্ঠ।
প্রতিষ্ঠানটির আগের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন কেনাকাটার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, কখনও কখনও মালামাল কেনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় অনুমোদন, অধিদপ্তর অনুমোদন, ক্রয় কমিটি ও মূল্য যাচাই কমিটির মিটিং, নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড ইস্যু, কার্যাদেশ চুক্তি সবই একই তারিখে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, আবু হেনা মোর্শেদ জামান সব ধরনের জরুরি কেনাকাটায় একক সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। সবশেষ এক লাখ কিট কেনায় অনিয়মের তথ্য পেয়ে বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল মহাখালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টোর পরিদর্শন করে। সেখানকার নথি ঘেঁটে জানা যায়, গত ৯ মে জিএস বায়োটেকের কাছ থেকে থেকে এক লাখ পিসিআর কিট বুঝে নিয়েছেন স্টোর কিপার। তবে তার কাছে কোনো ওয়ার্ক অর্ডার বা আনুষঙ্গিক কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। শুধু জিএস বায়োটেকের একটি অসম্পূর্ণ চালান কপি পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপোর (সিএমএসডি) উপসচিব শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলার উপযুক্ত ব্যক্তি নই। আমি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে এখানে অ্যাটাচমেন্টে আছি। কোনো অনিয়মের বিষয়ে জানতে হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষেরর কাছ থেকে জেনে নেন।’
অন্যদিকে, সিএমএসডির উপ-পরিচালক তউহীদ আহমদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টি পণ্যের কেনাকাটায় কোনো অনিয়ম হলে এবং সেক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগ পেলে বিষয়টি আমরা দেখব।’
নতুন প্রতিষ্ঠান জিএস বায়োটেকের মাধ্যমে করোনা কিটের মতো স্পর্শকাতর পণ্য সংগ্রহ ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু প্রেসক্রাইবড ফরম্যাট আছে, কোনো কিছু কিনতে হলে সেভাবে দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সিটিউ একটা প্রতিষ্ঠান আছে, তার মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড ডক্যুমেন্ট তৈরি করা থাকে, এই ডক্যুমেন্টস অনুযায়ী কারও যদি লাইসেন্স না থাকে বা অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকে তাহলে অটোমেটিক্যালি বাদ পড়ে যাবে। অভিজ্ঞতা না থাকলে তার এগেইন্সেটে একটা পয়েন্ট থাকে।’
তউহীদ আহমদ বলেন, ‘এ বছর টেন্ডার দিয়ে কোনো মালামাল সংগ্রহ করা হয় নাই। যে কয়টা মালামাল কেনা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি পারমিশনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।’
বিতর্ক ওঠা এক লাখ কিটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডিপিএম (ডাইরেক্ট পার্চেজ মেথড) পদ্ধতিতে আনা হলে সেটা আমার দেখার বিষয় না, এ বিষয়ে ডিরেক্টরের কাছে জানতে পারেন।’
গত বছর কার্যাদেশ ছাড়া কেনাকাটার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘কার্যাদেশ ছাড়া জিনিসপত্র আনায় সমস্যা হয়েছে। বিল-টিল আটকে আছে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামানের মোবাইল ফোনে অনেকবার কল করা তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
কিট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জিএস বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈকত সাহার মোবাইল ফোনে কল করেও সাড়া পায়নি নিউজবাংলা।