সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে ক্ষুব্ধ তরুণরা। নিজেদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে এখন সরাসরি আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে জেন-জি বা ‘জেনারেশন জুমার্স’। এই তরুণরাই জন্ম থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসা প্রথম প্রজন্ম। উন্নত দেশ হোক বা উন্নয়নশীল সমাজ, জেন-জিরা নানা উপায়ে নাড়িয়ে দিচ্ছে প্রচলিত শাসন, সংস্কৃতি ও চিন্তার কাঠামো। তাদের ভাষা, অভিব্যক্তি আর প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা।
জেন-জি পরিচয়ে আসলে কারা অন্তর্ভুক্ত? শুধু তুলনামূলক সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণরা, নাকি এর ভেতরে আছেন সুবিধাবঞ্চিতরাও? এ প্রজন্ম সত্যিই কি শুধু প্রশংসাযোগ্য কাজ করছে, নাকি তাদের আছে সীমাবদ্ধতাও? এ আয়োজনে রয়েছে এসবের অনুসন্ধান।
বৈশ্বিক তরুণ আন্দোলনের ঢেউ
মরক্কোর বিভিন্ন শহরে টানা কয়েক রাত ধরে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ চলছে। ‘জেন-জি-২১২’ নামে সংগঠিত এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে মূলত ছাত্র ও বেকার তরুণরা। তাদের দাবি স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে।
তাদের অভিযোগ, সরকার ২০৩০ বিশ্বকাপের অবকাঠামোতে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেও হাসপাতালগুলোতে যথাযথ সেবা নেই, গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসুবিধা সীমিত এবং শিক্ষাব্যবস্থা ধুঁকছে। বর্তমানে দেশটির যুব বেকারত্ব ৩৬ শতাংশ; প্রতি পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকের মধ্যে একজনেরও চাকরি নেই।
বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে আগাদির শহরে কয়েকজন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর ঘটনায়, যাদের অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসা জটিলতায় মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। এ পর্যন্ত তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা যায়।
প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখান্নোচ জানান, সরকার আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে ‘জেন-জি-২১২’ আন্দোলনকারীরা সরকারের পদত্যাগ দাবি করে যাচ্ছে।
উত্তাল মাদাগাস্কার
হাজার মাইল দূরে মাদাগাস্কারেও চলছে জেন-জি তরুণদের বিক্ষোভ। দেশজুড়ে পানি সংকট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রতিবাদে শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখন সরকার পতনের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনার পদত্যাগ দাবি করেছেন।
রাজোয়েলিনা সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করে বলেন, আমি তরুণদের কষ্ট বোঝতে পারছি।
তবে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, এ ঘটনায় কমপক্ষে ২২ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। সরকার অবশ্য এই সংখ্যাকে বিতর্কিত বলছে।
লাতিন আমেরিকায় তরুণদের বিক্ষোভ
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতেও তরুণদের আন্দোলন জোরদার হয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভের সূত্রপাত পেনশন আইনের সংস্কার নিয়ে, যা পরে দুর্নীতি ও অপরাধবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্তে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে গিয়ে এখন প্রায় তলানিতে- জুলাইয়ে করা এক জরিপে দেখা গেছে, তার জনপ্রিয়তা মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
নেপালে জেন-জি বিপ্লব
জেন-জি তরুণদের অন্যতম আলোচিত আন্দোলন ঘটেছে নেপালে। গত সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে শুরু হওয়া আন্দোলন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সরকার পতনের দিকে গড়ায়। অন্তত ২২ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন, রাজধানী কাঠমান্ডুর সরকারি ভবন আগুনে পুড়ে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীকে সরে দাঁড়াতে হয়।
এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও তরুণরা জেগে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক বার্ট কামার্টস বলেন, এই প্রজন্ম মনে করছে তাদের স্বার্থ কেউ প্রতিনিধিত্ব করছে না। তারা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রাখে, কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা তাদের আশা পূরণ করছে না।
এসওএএস সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবির সিনহা জানান, রুলিং বা ক্ষমতাসীন এলিটদের অগ্রাধিকার তরুণদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে জেন-জি প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও ধ্বংসাবশেষের অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যৎ যেন বাতিল হয়ে গেছে- এমন এক বাস্তবতায় তরুণরা এখন একে অপরের হাত ধরে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবাদের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে রাস্তায়
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। মরক্কোতে ‘জেন-জি-২১২’ নামের একটি ডিসকর্ড সার্ভার কয়েক দিনের মধ্যেই ৩ হাজার সদস্য থেকে বেড়ে ১ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছে যায়।
একইভাবে মাদাগাস্কারে ‘জেন-জি মাদা’ ফেসবুক ও টিকটকের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ডিজিটাল সংগঠনগুলো বিকেন্দ্রীকৃত, নেতা ছাড়া পরিচালিত হওয়ায় সরকারগুলোর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
জেন-জি প্রজন্ম এখন শুধু অনলাইন নয়, বরং বাস্তবেই পরিবর্তনের হাল ধরেছে। এবং সেই পরিবর্তনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক পর্দা থেকে সরাসরি রাস্তায়।