গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপের মধ্যে তৃতীয় দিন মঙ্গলবার শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ এবং মক্কায় ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা শরিফ তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করার মধ্য দিয়ে হজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শেষ করেছেন হাজিরা।
মক্কার বাইরে মরু এলাকা মিনায় তিন দিনের পাথর ছুঁড়ে মারার অনুষ্ঠানটি হজের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমগুলোর মধ্যে একটি। এটি অশুভ ও পাপ দূরীকরণের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। শনিবার আরাফাতের ময়দানে হাজিদের জমায়েতের একদিন পর এই কার্যক্রম শুরু হয়।
হজের শেষ দিনগুলোতে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা একসঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করে। এসময় আর্থিক সামর্থ্যের আলোকে বিশ্বাসীরা ইসলামের নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর বিশ্বাসের পরীক্ষার কথা স্মরণ করেন। আল্লাহ তাকে (নবী ইব্রাহিম) তার একমাত্র পুত্রকে (ইসমাইল) কোরবানি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবাদি পশু জবাই করে এর মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে মুসলমানরা।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন অনুসারে, এর অনুষ্ঠানগুলো মূলত নবী ইব্রাহিম ও তার পুত্র নবী ইসমাইল, ইসমাইলের মা হাজেরা এবং নবী মুহাম্মদের (সা.) বর্ণনায় উঠে এসেছে।
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী, সেদিন আল্লাহ তার রহমতের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইসমাইলকে রক্ষা করেন।
ইয়েমেন থেকে আসা হাজি মেজাহেদ আল-মেহরাবি পাথর ছুড়ে মারার অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনে বার্তাসংস্থা এপিকে বলেন, ‘আমি শান্তি পেয়েছি। এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। যদি কারও (মক্কায়) গ্র্যান্ড মসজিদ পরিদর্শন করার সুযোগ থাকে, তার তা অবশ্যই করা উচিত।’
নাইজেরিয়ার হাজি আমির ওমর প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ শেষ করার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার খুব ভালো লাগছে যে, আমি আমার ধর্মের একটি ফরজ পালন করেছি। আমি (আল্লাহর প্রতি) খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছি।’
মঙ্গলবার সৌদি আরবের জাতীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুসারে, মক্কা ও এর আশেপাশের পবিত্র স্থানগুলোতে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। প্রচণ্ড গরমে বৃদ্ধদের অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া, হিট স্ট্রোকে হাজিদের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে বলে জানা গেছে।
জর্ডান ও তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪১ জন জর্ডানের এবং ৩৫ জন তিউনিসিয়ার নাগরিক। মিসরের স্থানীয় গণমাধ্যমও মিশরীয় হাজিদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে। এবারের হজে এখনও মোট মৃত্যুর সংখ্যা জানায়নি সৌদি কর্তৃপক্ষ।
হজ পালনের সময় আরও অনেক হাজির হিসাব পাওয়া যায়নি। অনেক মিসরীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরাফাতের ময়দান ও মিনা উল্লেখ করে তাদের আত্মীয়দের খোঁজে পোস্ট দিয়েছেন। কয়েকজন হাজি গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের মক্কার আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের প্রতীকী পাথর নিক্ষেপের পর হাজিরা গ্র্যান্ড মসজিদে কাবা শরিফকে সাতবার তাওয়াফ করতে করতে মক্কার দিকে রওনা হন। শেষ তাওয়াফ নামে পরিচিত এই প্রদক্ষিণের মাধ্যমে হজের সমাপ্তি করে হাজিরা মক্কা শহর ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হজ শেষে পুরুষরা তাদের মাথা ন্যাড়া করবে এবং নারীরা সমস্ত চুল ধরে আঙুলের এক কড় কেটে ফেলবেন, যা ইসলামের নবী রাসূলের সুন্নাহ।
এরপর অধিকাংশ হাজি মক্কা ছেড়ে প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার দূরে মদিনা শহরের উদ্দেশে রওনা দেবেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কবর জিয়ারত করবেন।
নবীজির কবরের পবিত্র কক্ষটি নবীর মসজিদের অংশ, ইসলামের তিনটি পবিত্রতম স্থানগুলোর মধ্যে একটি। অন্য দুটি হচ্ছে- মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ ও জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ।
শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্য থাকলে প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে একবার হজ করা বাধ্যতামূলক (ফরজ)। অনেক ধনী মুসলমান একাধিকবারও হজ করে থাকেন।
সৌদি হজ কর্তৃপক্ষের মতে, ২০২৪ সালে ২২টি দেশের ১৬ লাখেরও বেশি হাজি এবং প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার সৌদি নাগরিকসহ ১৮ লাখ ৩ হাজারেরও বেশি মুসলমান হজ পালন করেছেন।
২০২৪ সালে বিধ্বংসী হামাস- ইসরায়েল যুদ্ধের পটভূমিতে হজের কার্যক্রম শুরু হয়। হামাস ও ইসরায়েলের এই যুদ্ধটি মধ্যপ্রাচ্যকে আঞ্চলিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনি উপত্যকায় যুদ্ধ এবং নিজ দেশে এক দশক ধরে চলা সংঘাতের কথা উল্লেখ করে ইয়েমেনের হাজি আল-মেহরাবি বলেন, ‘আমি প্রথমে গাজা ও পরে ইয়েমেনের জন্য প্রার্থনা করেছি।’