স্পেনের পর আয়ারল্যান্ড ও নরওয়েও ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো মানচেজের সঙ্গে বৈঠকের পর পৃথক সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিন নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে দুই দেশ।
শুক্রবার আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে পেদ্রো সানচেজের সঙ্গে বৈঠকের পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেন, আয়ারল্যান্ড শিগগিরই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। তবে ইউরোপের আরও দেশ যদি এ বিষয়ে রাজি থাকে, তাহলে তাদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে এ পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আয়ারল্যান্ড সফরের আগে ওইদিন নরওয়েতে যান সানচেজ। সেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইয়োনাস গার স্তোরের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনিও একই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন।
স্তোরে বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ওসলোও (নরওয়ের রাজধানী) প্রস্তুত। আরও যেসব দেশ একইরকম ভাবছে, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে এ ঘোষণা দেয়া হবে।
এর আগে গাজা উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। এতে ওই অঞ্চলের শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়া সত্যিকার অর্থে গতি পাবে।’
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঢুকে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র শাসক গোষ্ঠী হামাস। ওই হামলায় অন্তত এক হাজার ১০০ বেসামরিক ইসরায়েলি নিহত হন।
ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গাজায় লাগাতার হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলা শুরুর পর ৯ অক্টোবর গাজায় সর্বাত্মক অবরোধের ঘোষণা দেয় দখলদার ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু, অনাহার ও অবকাঠামোর ক্ষতি মিলিয়ে এই কয়েক মাসে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে গাজা।
মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে গাজা। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি ইসরায়েলের এমন অমানবিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মহল। তারই ধারাবাহিকতায় উপত্যকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এরইমধ্যে শুধু নরওয়ে আয়ারল্যান্ড নয়, স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ইউরোপের অনেক দেশই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
গত মাসে মাল্টা ও স্লোভেনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে স্পেন ও আয়ারল্যান্ড ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দেয়। সেসময় তারা জানায়, আমরা প্রস্তত, ‘সঠিক পরিস্থিতিতে’ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
শুক্রবার সানচেজের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে হ্যারিস বলেন, ‘বিষয়টি ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা (স্বীকৃতির) ঘোষণা দেয়ার খুব কাছাকাছি রয়েছি। সবাই মিলে আমরা এর বাস্তবায়ন করব।
‘নিজ দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের দাবি ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের। তারাও আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের মতো স্বাধীন ও স্বকীয়ভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মাঝে স্থান করে নেয়ার অধিকার রাখে।’
শুক্রবার ডাবলিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস। ছবি: সংগৃহীত
ওই সংবাদ সম্মেলনে সানচেজ বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথভাবে ঘোষণা দেয়া হবে। তবে অবশ্যই ঘোষণার আগে সময়ের উপযুক্ততা বিবেচনা করে হবে।
‘শুধু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণাই নয়, জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তারা যাতে স্বীকৃতি পায়, সেজন্যও আমাদের অটুট সমর্থন থাকবে।’
এক পায়ে খাড়া নরওয়ে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশ না হয়েও ইইউ দেশগুলোর সঙ্গে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ‘তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত’ নরওয়ে।
শুক্রবার শেনজেন অঞ্চলের সদস্য এ দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্তোরে বলেন, ‘তবে আমরা এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ ঠিক করিনি। একই মনোভাবের সব দেশের সম্মিলিত কার্যক্রম হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।’
শুক্রবার স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইয়োনাস গার স্তোরে। ছবি: সংগৃহীত
গত বছরের নভেম্বরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে নিজেদের সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে নরওয়ে।
এর আগে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতেও একবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি শান্তি আলোচনার আয়োজন করে দেশটি, যা পরবর্তীতে ‘অসলো চুক্তি’তে রূপান্তরিত হয়।
অসলো চুক্তি
অসলোতে ওই আলোচনার জন্য তৎকালীন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইসাক রবিন নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অসলো চুক্তি-১ স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৯৫ সালে মিশরের তাবায় অসলো চুক্তি-২ স্বাক্ষরিত হয়।
ওই চুক্তির মাধ্যমে দুপক্ষের মধ্যে যে বোঝাপড়া হয়, তা হলো- ফিলিস্তিনিরা নিজেদের অংশের ভূখণ্ড শাসনের অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল প্রথমে পশ্চিম তীরের জেরিকো এবং তারপর গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর পরিবর্তে, ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও)।
১৯৯৩ সালে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি ছিল দুপক্ষের মধ্যে প্রথম শান্তি চুক্তি। ছবি: বিবিসি
কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটায় ওই সমঝোতা চুক্তি। তখনকার প্রেক্ষাপটে একে বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে- ওই চুক্তির তিন দশক পর এখন আবার সেই ‘যুদ্ধাবস্থা’ বিরাজ করছে।
২০০৭ সাল থেকে কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস উপত্যকার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে পরিস্থিতির আবারও অবনতি হতে শুরু করে। হামাস অবশ্য অসলো চুক্তির সময়ই এর বিরোধিতা করেছিল।
সবশেষ ইসরাইলের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে হামাসের আকস্মিক অথচ ব্যাপক হামলার কারণে গত অক্টোবর থেকে উপত্যকায় সব ধরনের ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে।
ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি
গাজায় চলমান আগ্রাসনের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করে আসছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী। এ সপ্তাহে আইরিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারিসও নেতানিয়াহুর সেনা আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন।
তবে ইউরোপের দেশগুলোর এই কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেছে ইসরায়েল।
ইউরোপের দেশগুলোর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। ছবিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: সংগৃহীত
এ বিষয়ে আর না এগোতে হুঁশিয়ারি দিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের এ উদ্যোগ ‘সন্ত্রাসবাদের জন্য একটি পুরস্কার’ হিসেবে গণ্য হবে। সেইসঙ্গে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এ সংঘাত যদিও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব, তার সম্ভাবনাও কমিয়ে দেবে।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নারী ও শিশুসহ ৩৩ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সেইসঙ্গে আহত হয়েছেন ৭৬ হাজারের অধিক।
সর্বোপরি, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩৯টিই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা ও বিবিসি।