ওভাল অফিসে যে দলের কর্মকর্তারাই বসেন না কেন, অথবা হোয়াইট হাউসে যে দলের কর্মকর্তারাই থাকেন না কেন—ফিলিস্তিন নিয়ে তাদের মনোভাব অনেকটাই একই রকম দেখা যায়। অর্থাৎ, গত ৭৭ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করার কোনো দৃশ্যই তাদের অন্তর কাঁপাতে পারেনি। তবে নেতারা যাই ভাবেন না কেন, জনমনে ঘটে যাচ্ছে বিরাট পরিবর্তন।
গত বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়—যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ শতাংশ বাসিন্দা বিশ্বাস করেন যে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশগুলোর উচিত ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। রয়টার্স ও ইপসস পরিচালিত সেই জরিপটিতে ৩৩ শতাংশ উত্তরদাতা এমন ধারণার বিরোধিতা করেছেন এবং নয় শতাংশ কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
অনলাইনে ছয়দিন ধরে চলা এই জরিপে অংশ নিয়েছিলেন চার হাজার ৪৪৬ জন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ডেমোক্র্যেট পার্টির সমর্থকদের ৭৮ শতাংশ ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির ৪১ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সহানুভূতির কথা জানিয়েছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধ যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার পাশাপাশি কূটনৈতিক সহযোগিতাও করে আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মনে ইসরায়েল সম্পর্কে পরিবর্তিত মনোভাব ইহুদি রাষ্ট্রটির জন্য দুঃসংবাদ বটে।
ট্রাম্পের ওপর বাড়তি চাপ?
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান দিয়ে ভোটারদের মন জয় করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই নীতি চালানো উচিত বলে মনে করেন অনেক মার্কিনি। তারা আরও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তা তহবিল শুধুমাত্র মার্কিনিদের ভাগ্য উন্নয়নেই খরচ হওয়া উচিত।
এমন পরিস্থিতিতে রয়টার্স/ইপসসের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়—প্রায় ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৯ শতাংশ মার্কিনি বিশ্বাস করেন ইসরায়েল গাজায় মাত্রাতিরিক্ত সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।
গত ৩১ জুলাই টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বোঝাতে মার্কিন পার্লামেন্ট কংগ্রেসে প্রথম রিপাবলিকান হিসেবে মারজোরি টেইলর গ্রিনি ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি উগ্র ডানপন্থি ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
রিপাবলিকানদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নন। তার মতো আরও অনেক রিপাবলিকান নেতা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করছেন। অবশেষে, ট্রাম্পকেও গাজায় খাবারের চরম ঘাটতির কথা স্বীকার করতে হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেমোক্র্যাটদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমাগত চাপে রিপাবলিকান পার্টির ভেতর ইসরায়েল নিয়ে ভিন্ন মত তৈরি হচ্ছে। তারা গাজায় খাদ্যাভাব দূর করতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
অনেকের মতে, মার্কিন মুল্লুকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি বাড়লে দিন শেষে তা ইসরায়েলের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি, জনমতে পরিবর্তনের সুর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলে তাহলে বিপদে পড়তে পারে তেল আবিব। কেননা, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি সামরিক সহয়তা পেয়ে থাকে।
গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষের কথা নিশ্চিত করল আইপিসি
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষের বিষয়টি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)। সংস্থাটি তাদের খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ ও ভয়াবহ স্তর ফেজ-৫ এ উন্নীত করেছে।
আইপিসি জানিয়েছে, গাজা গভর্নরেটের অন্তর্ভুক্ত গাজা সিটি ও পার্শ্ববর্তী এলাকা এখন দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছে। একই সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এই ‘বিপর্যয়কর পরিস্থিতি’ দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আইপিসি নিজে সরাসরি দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে না। তবে তাদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন এজেন্সি আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষের ঘোষণা দিয়ে থাকে।
সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতি এরই মধ্যে ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে ও দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সংকট আরও বিস্তৃত হবে।
গাজায় নিহতদের ৮৩ শতাংশ বেসামরিক নাগরিক
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলায় নিহতদের সিংহভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরায়েলি সেনাদের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের গোপন নথি বিশ্লেষণ করে উঠে এসেছে এই তথ্য। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ১৯ মে পর্যন্ত ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের হাতে থাকা তথ্য অনুসারে, হামাস ও ইসলামিক জিহাদের প্রায় ৮ হাজার ৯০০ যোদ্ধা ‘নিহত’ বা ‘সম্ভাব্যভাবে নিহত’ হয়েছে। তবে সেই সময় পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, উপত্যকায় মোট নিহতের সংখ্যা ৫৩ হাজার, যার মধ্যে সামরিক যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।
তথ্যগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট নিহতের মাত্র ১৭ শতাংশ যোদ্ধা, আর বাকি ৮৩ শতাংশই বেসামরিক সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ গাজায় প্রাণ হারানো প্রতি ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক।
দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, গাজার পরিস্থিতি সিরিয়া ও সুদানের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের চেয়েও মারাত্মক, যেখানে বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। অথচ গাজায় নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী এমনকি ইসরায়েলি শিক্ষাবিদরাও স্পষ্টভাবে বলছেন, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।
তবে এ নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তাদের নিজস্ব ডাটাবেজের তথ্য অস্বীকার করে। সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্রের দাবি, ‘প্রতিবেদনে প্রকাশিত পরিসংখ্যানগুলো ভুল।’ তবে কোন সংখ্যাগুলো ভুল তা তারা ব্যাখ্যা করেননি।